মাইওপিয়ার উদাহরণ: মহাকাশবিজ্ঞান

১৯৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে নাকিব বসে পড়ছিল। এমন সময় হঠাৎ চলে গেল বিদ্যুৎ। ঢাকা শহরের লোডশেডিং সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে তার। এক ঘন্টা পরে চলে আসবে। তাই মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে, পড়ছিল। ১১টা বেজে গেলো, কিন্তু বিদ্যুৎ আসার নামগন্ধ নেই। সে একটু চিন্তায় পড়লো। সোয়া এগারোটার দিকে নাকিবের বড় ভাই এসে ঘরে ঢুকলেন। তিনি ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন বেড়াতে, মাত্র এলেন। তিনি আসতেই নাকিব বললো: ‘ভাইয়া কারেন্ট নাই, গরম লাগতেছে নিশ্চয়ই? এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে, কারেন্ট দিতেছে না।’ ভাইয়া তার উত্তরে জানালেন: ‘তাই নাকি? বুঝলাম না, আসলেই কিছু হইলো নাকি…মাওয়ায় ঢোকার পর থেকে আর কারেন্ট পাই নাই পথে কোথাও।’ নাকিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বিপদের গন্ধ পেলো। সাথে সাথে সে ফোন তুললো বন্ধু নয়নকে ফোন করতে, কিন্তু ফোন তুলে শুনলো ডেডটোন। ফোন রেখে নাকিব সাথে সাথে টিভি অন করতে গেলো কোনো গোলযোগের খবর শুনবে বলে, তখন মনে পড়লো বিদ্যুৎ ছাড়া টিভি কিভাবে চলবে। সাথে সাথে সে তার মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে ইয়ারফোন লাগিয়ে রেডিও চালু করলো, কিন্তু রেডিওতে শুধু ঝিঝিঝিঝি… কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে!

পুরো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, টেলিফোন ব্যবস্থা, রেডিও সিগন্যালিং ব্যবস্থা বিকল হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ যেসব স্থানে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে, তারাও অন্ধকারে। সারা বাংলাদেশে ব্ল্যাকআউট, একাত্তরের ২৫শে মার্চের মতো হামলে পড়লো নাকি কোনো হানাদার? প্রধানমন্ত্রীর স্পেশাল প্রটোকল দ্রুত সক্রীয় হয়ে গেলো। রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র বাহিনী বেরিয়ে এলো। দ্রুততার সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলো। ভোর হবার আগেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করা হলো।

ভোরেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সক্রীয় করা হলো। ধীরে ধীরে সারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল করা হলো। জনগণ টিভি দেখে জানলো এই মহা বিপর্যয়ের কথা। সমালোচনার ঝড় তুললো বিরোধী দলগুলো: সরকারের নাকের ডগায় বিদেশী শক্তি দেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। বিরোধী দলের চাপে প্রধানমন্ত্রী ডেকে পাঠালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। আশু কারণ প্রদর্শনের দাবি জানালেন মন্ত্রীর কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই চাপ চাপালো পুলিশের কাঁধে। সারা বাংলাদেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একযোগে এতো বড় কর্ম সংঘটনের কোনো ক্লু খুঁজে পেলো না। কয়েকটা চোর-ছ্যাচ্চড় ধরা পড়লো রাত করে বাইরে ঘোরাফেরার অপরাধে। কিন্তু এই ঘটনার সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলো না বলে আবার সক্রীয় হলো বিরোধী দলগুলো। চাপ দিলো প্রধানমন্ত্রীর উপর, সেই চাপ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আবার পুলিশের ঘাঢ়ে। পুলিশ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে এক ঘাগু ডাকাতকে ধরে প্রমাণ ছাড়াই চার্জশিট ঝুলিয়ে দিলো। সাংবাদিক সম্মেলনে সেই লোক ঘুণাক্ষরেও এই দায় স্বীকার করছে না, আর পুলিশ বারবার রিমান্ডের আবেদন জানাচ্ছে। ঘটনার সুরাহা হচ্ছে না দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক গলায় ব্যঙ্গ মাখিয়ে সমালোচনা করলেন: তাহলে কি ভিনগ্রহবাসী এসে একাজ করেছে?

সপ্তাহখানেক যাবার পর একদিন বুয়েটের এক ছাত্র শখের বসেই নাসা’র ওয়েবসাইট ঘাঁটতে গিয়ে বাংলাদেশের নাম দেখে আটকে যায়। খবরটা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলে মূল ঘটনা।

এপর্যন্ত বলা প্রত্যেকটা কথা আসলে শ্রেফ একটি গল্প, কোনো বাস্তব ঘটনা নয়। কিন্তু আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন, যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা নিয়ে এইসব ঘটনা ঘটবে না? আপনি হলফ করে বলতে ভয় পাবেন, কারণ যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ এখানে করা হয়েছে গল্পচ্ছলে, বাঙালি সেসব করবেই। আর সবার মতো করে ভাববে, আর সবার কথায় গা ভাষাবে…

এবারে আসুন জানি, আসলে কী জানতে পেরেছিল বুয়েটের সেই ছেলে: সে জেনেছিল, কাজটা বাংলাদেশের কেউ তো করেইনি, পৃথিবীরই কেউ করেনি। তাহলে কি ভিনগ্রহবাসী এসে…?!

…করেছে সূর্য (যদি সূর্যের নিজের করার ক্ষমতা থাকে)। হ্যা, সূর্য। আপনারা শীতকালে গাছের পাতা কুড়িয়ে কখনো যদি আগুন জ্বেলে থাকেন, তবে সেখানে পাতাগুলো একটু নেড়ে দিলে দেখবেন আগুনটা হঠাৎ করে লাফ দেয়। সূর্যের আগুনও এরকমভাবে লাফ দেয়। বইয়ে-পত্রে এর নাম ‘সোলার ফ্লেয়ার’ (Solar Flare)। সূর্যটা যেমন বিশাল, তার কারবার-সারবারও বিশাল। এই ফ্লেয়ারগুলো আকাশে কয়েক হাজার মাইল পর্যন্ত উঠে যায়। প্রকৃত হিসাব কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। যাই হোক, এটা হলো যা আমরা দেখতে পাই খালি চোখে টেলিস্কোপের মাধ্যমে। যে ব্যাপারটা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, সেটা হলো বৈদ্যুতিক চার্জসমৃদ্ধ একটা বিশা–ল ঝড় বেরিয়ে আসে ঐ ফ্লেয়ার থেকে, যার কেতাবি নাম “সোলার উইন্ড” (Solar Wind) বাংলায় “সৌরবায়ু”। টেলিস্কোপ দিয়ে সোলার ফ্লেয়ার দেখা যাওয়ার ২৮ ঘন্টা বা তারও কিছু বেশি সময়ের মধ্যে এই সৌরবায়ু পৃথিবীর কক্ষপথে এসে পৌঁছে যায়। (অবশ্য এব্যাপারে বিভিন্ন উৎসে বিভিন্ন তথ্য পাচ্ছি: কোথাও লেখা ২ ঘন্টা, কোথাও ২৪ ঘন্টা। তবে সৌরবায়ুর গতির ব্যাপারে Space.com-এর সূর্য সম্পর্কিত প্রাজিপ্র^-তে বলা হয়েছে: সৌরবায়ুর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৪০০-১০০০ কিলোমিটার।) এসে আঘাত করে পৃথিবীকে। এরকম একটা সৌরবায়ু যদি পৃথিবীকে আঘাত করে, তবে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ধুলিষ্যাৎ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। অথচ এরকম সৌরবায়ু মাঝে মাঝেই আঘাত করছে পৃথিবীকে, কিন্তু আমাদের কিছু হচ্ছে না। কারণ কী?

কারণ হলো আমাদের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। সৌরবায়ু এসে আমাদের চৌম্বকক্ষেত্রে আঘাত করে, আর চৌম্বকক্ষেত্রে ঘষা খেতে খেতে পৃথিবীকে পার করে চলে যায়। এই ঘষা খাওয়ার সময় অপূর্ব একটি দৃশ্যের অবতারণা হয়। একটা কাচের বোয়ামের উপর একখানা কাপড় ঘষিয়ে ঘষিয়ে নিলে কাচের বোয়ামের ভিতর থেকে যেভাবে কাপড়কে দেখা যাবে, ঐ দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে, পৃথিবী থেকে কিন্তু আমরা খালি চোখে সেই ব্যাপারটা দেখতেও পারি। ব্যাপারটা বুঝতে আপনাকে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

চিত্রে দেখা যাচ্ছে সৌরবায়ু কিভাবে পৃথিবীর চৌম্বকীয় বলয়ে ধাক্কা খাচ্ছে
চিত্রে দেখা যাচ্ছে সৌরবায়ু কিভাবে পৃথিবীর চৌম্বকীয় বলয়ে ধাক্কা খাচ্ছে (ছবির উৎস: yksd.com)

মনে আছে, ছোট ক্লাসে চুম্বকের অধ্যায়ে একটা দন্ড চুম্বকের গা ঘেষে এমাথা থেকে অমাথা পর্যন্ত কতগুলো টান টান টান টান দেখতাম, ক্যাপশনে লেখা থাকতো দন্ড চুম্বকের বলয়। ঠিকমতো মনে করলে ঠিকই মনে করতে পারছেন যে, রেখাগুলো একমাথা থেকে বের হতো, মাঝখানে ছড়িয়ে যেতো, আবার অন্য মাথায় এসে একসাথে হয়ে যেতো। পৃথিবীর চুম্বকীয় বলয়টাও সেরকমই: উত্তর মেরু থেকে রেখাগুলো বেরিয়ে ছড়িয়ে গিয়ে দক্ষিণ মেরুতে এক বিন্দুতে মিলেছে। চিত্রটা একটা কল্পনা করলে বুঝতে পারবেন, দুই মেরু অঞ্চলে চৌম্বক ক্ষেত্রের বলয়টা পৃথিবীর মাটির কত কাছাকাছি। তাই ঐ এলাকার লোকজন একটা দারুণ জিনিস দেখতে পারে। ঘষা খেয়ে যাবার সময় কিছু চার্জযুক্ত কণা আটকা পড়ে চৌম্বকীয় বলয়ে, আর তাই ঐসব এলাকায় রাতের আকাশে দেখা যায় অনেক অনেক হালকা আলো একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করে ফিরছে, যার কেতাবি নাম ‘অরোরা’ (Aurora), বাংলায় ‘মেরুজ্যোতি’। দিনের বেলায়ও অরোরা হয়, কিন্তু অরোরা’র আলো সূর্যের আলোর চেয়ে তীব্র নয় বলে দেখা যায় না।

এখন, এই সৌরবায়ু থেকে পৃথিবী বেঁচে যায়, কারণ আমাদের চৌম্বকক্ষেত্র। কিন্তু কোনো কারণে এই সৌরবায়ু আর তার তেজষ্ক্রিয়তার মাত্রা বেশি হলে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে ভেদ করে পৃথিবীর মাটিতে পৌঁছে যায়। তখন ফট করে যে ঘটনাটা ঘটে: বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারগুলোর উপর অতিরিক্ত মাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, সে ভর সইতে না পেরে ট্রান্সফর্মার মারা যায় অথবা অকেজো হয়ে যায়। তাই তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে গোটা এলাকা -সেই এলাকাটুকু, যেটুকু, সৌরবায়ু আঘাত করার সময় সূর্যের দিকে মুখ করে ছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সব ধরণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার একটা বড় কারণ ছিল বাংলাদেশের যন্ত্রপাতিগুলো তেজস্ক্রিয়তা-প্রতিরোধক না।

কিন্তু আগেই বলেছি, উল্লেখিত ঘটনাটি বাংলাদেশে ঘটেনি, এটা শ্রেফ একটা রূপকল্প। তাহলে  প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক: বাস্তবে কি এসব ঘটে? উত্তর হলো: হ্যা, শুধু ঘটেই না, ইতোমধ্যে ঘটেও গিয়েছে। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ এরকম একটা দুঘর্টনা ঘটেছে কানাডার কুয়েবেকে। ৯ ঘন্টার জন্য কালোরাত্রিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল পুরো এলাকা।

কী বুঝলেন? যদি বাঙালিকে নতুন কিছুর পথ দেখাতে হয়, তবে অন্যান্য বাঙালির মতো করে ভাবলে চলবে না। জ্ঞান বাড়ানোর পথ খুঁজুন। আলাদা করে দেখুন, অন্যভাবে দেখুন, অন্যভাবে ভাবুন, ভাবতে শিখুন। মনে রাখবেন, এতে করে আপনি বাঙালির মাঝে ‘একঘরে’ হয়ে যাবেন; যা বোঝেন, যা বুঝছেন, কারো সাথে শেয়ার করার মতো কেউ থাকবে না। …তারপরও আপনি আলাদা হবেন, নতুন করে দেখবেন। একা হয়ে গেলেও তা করবেন, কারণ আপনার হাত ধরেই বাঙালির উত্থান।

নেতা একজনই হয়।

– মঈনুল ইসলাম


বাড়তি জানার সূত্র:

উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ:

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*