কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে – পাহাড়ের উল্টো পিঠে : পর্ব ২

রৌদ্র্যোজ্জল শরতের কড়া রোদে পাইন্দু খালের বালুময় প্রান্তরে হাঁটার অভিপ্রায়ে বের হওয়া আমরা চারজন গিয়ে পড়লাম একেবারে পাহাড়ি ঢলে উত্তাল পাইন্দু খালের তোপের মুখে। সেই তোপে পা না দিতে পাশের পাহাড় ধরে চলতে গিয়ে সামনে পড়লো ঘন জঙ্গল। আর সেই ঘন জঙ্গলে ঢুকে বিভিন্ন পথে, বিভিন্নভাবে ঘুরে চেষ্টা করলাম আমরা, কিন্তু ঘন জঙ্গল আমাদের সকল পথই রুদ্ধ করে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। হাল ছেড়ে দিলো তানভির।

আমিও একটু আশাহতই হলাম। মোহন ওর বড় ব্যাগটা নিয়ে এই যুদ্ধে কষ্টই করছে, তবু সে নিশ্চুপ – কোনো অভিব্যক্তি জানাচ্ছে না। কিন্তু আবু বকর অন্য ধাতুতে গড়া। মনে একটাই ইচ্ছা – সামনে যেতে হবে, আর এপথেই এগোতে হবে।

‘পথ নেই’ বলে কোনো কথা নেই।

সামনে এগোতেই হবে, এবং সেটা এদিকেই হবে। কারণ এরচেয়ে উত্তম বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তাঁবু দুইটা হাতে রেখে এগোনো যাচ্ছে না। এগুলোর একটা বিহীত করা দরকার। আমি জানালাম, আমার কাছে রশি আছে, ওগুলোকে যেহেতু ব্যাগের ভিতরে ঢোকানো যাচ্ছে না, রশি দিয়ে ব্যাগের সাথে কষে বেঁধে ফেলা যেতে পারে। আমরা ঐ জঙ্গলের মধ্যেই এক জায়গায় থামলাম। পানি খেয়ে নিলাম। এতোক্ষণের বাসযাত্রার ধকল আর ট্রেকে হাঁপাইনি, অথচ এই সামান্য সময় জঙ্গলের সাথে যুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠেছি বেশ। কিন্তু রশি দিয়ে তাঁবু ব্যাগের সাথে বাঁধায় ঠিক জুৎ হচ্ছে না। অবশেষে আবু বকরই মোহনের ব্যাগ আর তাঁর নিজের ব্যাগের এদিক-সেদিকের স্ট্র্যাপগুলো খুলে খুলে ক্রস করে তাঁবুগুলোকে বেঁধে ফেলার একটা কৌশল আবিষ্কার করে ফেললেন।

একটু সময় লাগলো, আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আর তখনই বুঝতে পারলাম, এই বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলে আমরা কতটা অসহায় – মশারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে আশেপাশে। একটা কামড়ও বসিয়ে দিয়েছে আমার হাতে। শংকিত হয়ে উঠলাম। আসার আগে ম্যালেরিয়ার ঔষধ খেয়ে আসার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এক মাসব্যাপী ঔষধের কোর্স দেখে নিরুৎসাহিত হয়েছিলাম আমি – ভুলই করেছিলাম – চরম ভুল। জীবনের দাম এক মাস না – খুব বড় ভুল করেছি। একবার ম্যালেরিয়া হলে আর রক্ষে নেই। এমনকি আমাদের ডাক্তার মোহন জানিয়ে দিল, ম্যালেরিয়ার জীবাণু সাথে সাথে আক্রমণ না করলেও এক বছর পরেও আক্রমণ করে বসতে পারে। দলের মধ্যে সে একাই ম্যালেরিয়ার ঔষধ খেয়ে এসেছে, আর সাথে করে নিয়ে এসেছে ডোজ সম্পূর্ণ করবার জন্য। আমরা শুধুই ওডোমোস নিয়ে এসেছি, তাও এখনও মাখিনি কেউই। যদি মশার কামড় খেয়েই ফেললাম, তাহলে আর মশা নিরোধক ঔষধের কী মানে থাকলো? মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করলাম, এই মশাটা যেন ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী না হয়। আবু বকর জানালেন, চলা শুরু করলে মশা কামড়াতে পারবে না। তাই তাঁবু বাঁধা চলাকালীন অন্তত হাত-পা নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। শার্টের আস্তিনটা নামিয়ে দিয়ে হাতটা আগেই ঢাকা ছিল।

মশা নিরোধক ওডোমস: পাহাড়ে-জঙ্গলে

তাঁবু বাঁধা হয়ে গেলে মোহনের বিশাল ব্যাগে আরো একটু ওজন যোগ হলো, তাই ওকে আরো একটু এক্সট্রা কেয়ারের দরকার হয়ে পড়লো, যদিও সে কারোর সহায়তা চাইছে না। আবু বকর আর তানভিরের ব্যাগ ছোট, তাই আবু বকরের ব্যাগে তাঁবু যোগ হওয়ায় সামান্য যা ওজন বাড়লো, তাতে সমস্যা হবার কথা না। আবার আমাদের পথচলা শুরু হলো। জঙ্গল, সে যত ঘনই হোক না কেন, ডাল সরিয়ে, হাত দিয়ে ভেঙে, লতা পাতা সম্ভব হলে হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে কিংবা শরীর এঁকিয়ে বেঁকিয়ে লতা পাতা থেকে ছাড়িয়ে, কোথাও উঁচু ঢাল বেয়ে, কোথাও সমতল মাড়িয়ে আমাদের এক যুদ্ধই শুরু হলো বলা চলে।

মোহন তখন একটা কথা বললো, “আরে পথ থাকে নাকি, বিয়ার গ্রিল্‌স কি জঙ্গলে পথ ধরে হাঁটে নাকি, পথ তৈরি করে নেয়।” এই কথাটা আমার মনের মধ্যকার সামান্যতম দ্বিধাকে বেমালুম দূর করে দিলো। ঠিকই বলেছে, পথ তৈরি করে নিতে হয়। মনে জোর পেলাম। আমার যখন এই অবস্থা, তখন মনে পিছুটান দেয়া তানভিরের কী অবস্থা সেটা আশাই করা যায়। কিন্তু আমি জানি, বিয়ার গ্রিল্‌সের চরম ভক্ত তানভিরের জন্যও এই কথাটাই একটা ঔষধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মোহনের কথাটাকে আমি জোর গলায় সমর্থন জানালাম। কিন্তু আবু বকর এই কথাটাকে বিন্দুমাত্র পছন্দ করতে পারলেন না। তিনি বিয়ার গ্রিল্‌সের অনুকরণ পছন্দ করেন না। আমি বললাম, অনুকরণ কেন, উৎসাহতো নেয়া যায়। আবু বকর সেটা মেনে নিলেন।

আবু বকরকে বললাম, “সামনে যান, পথ দেখান”। কোনো কোনো দিকে আবু বকর গিয়ে থেমে দাঁড়াচ্ছেন। এখান থেকে না দেখা যাচ্ছে পাইন্দু খাল, না দেখা যাচ্ছে আকাশের কোনো কিনারা। কোনদিকে যে গেলে পথ পাওয়া যাবে আল্লা’ মালুম। শুধু এতোটুকু আন্দাজ করতে পারছি আমরা, আমাদের ডানদিকে পাইন্দু খাল আছে, আর আমরা একটা পাহাড়ের দিকে উঠে যাচ্ছি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আবু বকর থেমে যাওয়া মানে পথের কোনো দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার হয়তো পিছিয়ে এসে বিকল্প কোনো পথ করে পাহাড়ের দিকে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো পথই আগের পথের সহজ বিকল্প না – সব দিকেই সমান ঘন জঙ্গল।

জঙ্গল আমাদেরকে যেভাবে গ্রাস করে নিয়েছিল, পথ চলতে চলতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি আমরা। কিছুদূর এগোচ্ছি, আবার হয়তো থমকে দাঁড়াচ্ছি জঙ্গলের সামনে। কোথাও লতাতে ব্যাগ আটকে বিপদে পড়ছি। সেটা ছাড়াতে হয় কেউ একজন সহায়তা করছে, নয়তো কেউ কাছে না থাকলে নিজেই পিছনে সরে এসে লতা থেকে বের হয়ে আবার অনেকটা নিচু হয়ে ব্যাগ বাঁচিয়ে এগোতে হচ্ছে। এভাবেই জঙ্গল-যুদ্ধে আমাদের পথচলা চলছেই… এভাবে, একসময় আমরা একটা বড় গাছের কাটা কান্ডের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। আর সেটাই আমাদের ভাগ্যকে প্রসন্ন করে তুললো।

 

একটা গাছ কাটা হয়েছে এখানে, টাটকা সব। হয় আজকে, নয়তো গতকালকে কাটা হয়েছে। গাছ কাটা মানে দুটো অর্থ:

১. এখানের লোকজন এসেছিল, তাহলে আসার পথ আছে, আর সেই পথে যাওয়াও যাবে; আর

২. যারা গাছ কাটতে এসেছে, তারা লোক ভালো নাও হতে পারে, আশেপাশে থাকলে, আর আমাদেরকে তাদের কাজের থ্রেট ভেবে থাকলে আমাদের কপালে শনি আছে।

তবু আমরা কিছুটা খুশি হলাম। কাটা গাছটা অবশ্যই এখান থেকেই খালের পানিতে নামানো হয়েছে, কারণ এটাই গাছ কেটে এখান থেকে বের করে নেয়ার উত্তম পন্থা। কিন্তু ঢালের দিকে অনেক খুঁজেও গাছ নামিয়ে নেয়ার মতো কোনো চিহ্ন, যেমন: ঘাস-লতা-পাতা মাড়ানো, ভাঙা, মেঝেতে ঘষার দাগ – কিছুই পেলাম না আমরা। হয়তো অনভ্যস্থ চোখ সূক্ষ্ম কোনো সূত্র দেখেনি। কিন্তু একটা ব্যাপার ঠিকই নজরে এলো আবু বকরের, একটা পায়ে চলা পথ – জঙ্গলের মেঝেতে খুব সামান্য জায়গার ঘাস লতা-পাতায় একটু ছেদ চোখে পড়ছে – ওখান দিয়ে লোকজনের চলাচল হয়েছে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। সুতরাং তৈরি করা সেই পথে গেলে এই জঙ্গল থেকে একটা বেরোবার পথ যে হবে, এটা নিশ্চিত।

ঐ পথ ধরেই হাঁটা শুরু করলেন দলনেতা। বাকিরা অনুসরণ করলাম। পথটা আমাদেরকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। পথটা ক্রমশ বড় হচ্ছে, এবারে পায়েচলা পথটা স্বচ্ছভাবে চোখে পড়ছে। তার মানে এদিকে মোটামুটি নিয়মিত যাতায়াত পথ আছে পাহাড়িদের। আবু বকর হাসলেন, “আমরা তো দেখি পাহাড়ের হাইওয়ের দেখা পেয়ে গেলাম।” আসলেই তা। পাহাড়ে যে জঙ্গলের সাথে যুদ্ধ করেছি আমরা এতক্ষণ, এই পথটাকে এখন হাইওয়েই মনে হচ্ছে।

পথটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে, কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে, কোথাও পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে। আমি তখন আবিষ্কার করলাম, আমি আমার ব্যাগে পানির দুটো বোতল নিয়ে এসেছিলাম, তার একটা, ঐ জঙ্গলের সাথে ঝুঝতে থাকাকালীন কোথাও টানের চোটে পড়ে গেছে। পানির একটা বোতল হারিয়ে ফেলেছি ট্রেকের প্রথম কয়েক ঘন্টায়ই। ☹️ …যাহোক, একসময় আমরা এই পাহাড় থেকে বামপাশে আরেকটা পাহাড় দেখতে পেলাম, এবং প্রথমবারের মতো একজন মানুষকে দেখতে পেলাম। একটা জুমঘরের সামনে লোকটা কিছু একটা করছে। বিয়ার গ্রিল্‌সের কথা মনে হলো, এক্সট্রাকশন দৃশ্যে একজন মানুষের দেখা পেলেই হাত উঁচিয়ে দেয়, হেই। ঐ ব্যক্তিটা তাঁকে উদ্ধার করে। আমাদের দুরবস্থার পরে ঐ মানুষটাকে দেখেও আমাদের হয়তো তেমনটাই করার দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে অবস্থা ভিন্ন। কে যে কী, না জেনে অযথাই হাই-হ্যালো করার কোনো মানে নেই। …আমরা দেখেও না দেখার ভান করলেও লোকটা ঠিকই আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। আমরা পাহাড়ের কাঁধ ধরে যতই সামনে এগোচ্ছি, লোকটা সেদিকেই আমাদের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে – কারা এরা?

আকাশের অবস্থা ভালো না। মেঘাচ্ছন্ন আর ঝিরি ঝিরি বাতাসের আবহাওয়া এখন ঘন মেঘ দিয়ে ছেয়ে দিয়েছে আকাশকে। একটা ব্যাপার পরিষ্কার – বৃষ্টি আসন্ন। কোথায় কড়া রোদের প্রস্তুতি, আর কোথায় এখন বৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে – ভেবেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথাটা চক্কর দেয়ার কারণ কয়েকটা: ১. বৃষ্টির কোনো প্রস্তুতিই আমাদের নেই, ব্যাগগুলো সব জলরোধী না – বৃষ্টিতে পড়লে সব ভিজবে। ২. বৃষ্টির মধ্যে তাঁবু খাটাতে গেলে খবরই আছে। ৩. বৃষ্টির মধ্যে আগুন ধরানো মহা মসিবতের কাজ।

পথটা এভাবেই নামতে থাকলো নিচের দিকে - সামনে আবু বকর, তারপর মোহন, আর তানভির
পথটা এভাবেই নামতে থাকলো নিচের দিকে – সামনে আবু বকর, তারপর মোহন, আর তানভির

যাহোক, ঐ ব্যক্তিকে তার জায়গায় রেখে আমরা পাহাড়ি হাইওয়ে ধরে এগোতেই থাকলাম। একসময় পথটা নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। আমরা সন্তুষ্ট হলাম। কারণ তার মানে, পথটা আমাদেরকে পাইন্দু খালে নামিয়ে দিবে। কিন্তু একটা ব্যাপার আশ্চর্য, আমরা একেকজন পাইন্দু খালকে একেক দিকে বলছি। যেহেতু পাইন্দু খাল এতক্ষণ আমাদের ডানদিকে ছিল, তাই আমি ওটাকে ডানদিকে বলছি, আর আবু বকর বলছেন, সামনের বামদিকে কোথাও। আকাশে সূর্যও নেই যে, দিক ঠিক করে কথা বলবো। অগত্যা ঢালু পথটাই আমাদেরকে ঝিড়িতে নামিয়ে দিবে, সেই আশা নিয়ে নামতে থাকা।

এক জায়গায় গিয়ে পথটা ঠিক ডানে-বামে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেলো। কোন দিকে যাবো? ঠিক করা হলো, দুজন দুজন করে দুদিকেই খানিকটা যাবো। যাবার পথ আছে মনে হলে এগোব, নয়তো ফিরে এসে বিপরীত পথ ধরবো। আমি আর তানভির গেলাম ডানদিকেরটা ধরে, আর আবু বকর আর মোহন গেলেন বাম দিকেরটা ধরে। আমরা দুজন কিছুদূর এগোতেই একজন পাহাড়িকে ওদিক থেকে এগোতে দেখলাম। এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম? জানা গেল, সামনেই পাইন্দু খাল। আর সামনে একটা পাড়াও আছে। ততক্ষণে বামদিকের পথে আশানুরূপ ফলাফল না দেখে আবু বকরও এসে পড়েছেন। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিশনারী হাসিখানা দিয়ে সম্ভাষণ জানিয়ে তথ্য নিতে থাকলেন পাহাড়ির থেকে। আমি, সাথে করা প্রিন্ট করে নিয়ে আসা ম্যাপটা বের করলাম। লোকটার বলে যাওয়া পাড়াগুলো ম্যাপের সাথে মিলাতে থাকলাম। কিন্তু মিললো না।

পথে দেখা এক অজানা ফল - এটার পাকা ফল নাকি খাওয়া যায় (ছবি: তানভির)
পথে দেখা এক অজানা ফল – এটার পাকা ফল নাকি খাওয়া যায় (ছবি: তানভির)

আবু বকর বললেন, ম্যাপ বাদ দেন, পাড়াগুলোর নাম লিখে নেন। আসলেই, ম্যাপের সাথে মিলাতে গেলে খালের এপাড়-ওপাড়ের পাড়াগুলোর অবস্থানের সাথে লোকটার বলা অবস্থানের অমিল বেশি। তার একটা বড় কারণ হলো, গুগলের তোলা ছবিগুলোতে মানচিত্রের ঠিক ঐ অংশের ছবিগুলো ২০১৪’র মে মাসে তোলা। দুই বছরে অনেক পরিবর্তন হতে পারে। তাই মানচিত্র রেখে পরপর পাড়াগুলোর নাম লিখে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। পরে ম্যাপ দেখে মিলিয়ে নেয়া যাবে। আরো কয়েকজন লোকও এই পথে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত পাড়াগুলোর অবস্থান আর নাম জেনে নিয়ে লোকটার থেকে আবু বকর বিদায় নিলেন।

সুতরাং আমরা সঠিক পথেই আছি। এই পথেই পাইন্দু খালে নামা যাবে। পথটা খাড়া, আর ভেজা, পিচ্ছিল। কিন্তু একেবারে ধাপ করে করে সিঁড়ি কাটা মাটিতে। পাড়ার লোকেরা নিয়মিত যাতায়াত করে বলেই এই সুব্যবস্থা। যাহোক, পথটা যেদিকে যাচ্ছে, সেখানে কয়েকটা মুসলমান বাঙালি ছেলেকেও দেখা গেলো। তাদের থেকেও একই নির্দেশনা পাবার পরে কোনো সন্দেহ রইলো না। আমরা ঐ পথ ধরেই সামনে পাইন্দু খালের দিকে এগোতে থাকলাম। পথে একটা অজানা লোমশ গোটা দেখলাম গাছে, তানভিরকে দেখালাম। পরে শুনলাম, ঐ মুসলমান ছেলেগুলো নাকি এরই একটা পাকা ফল ওকে খাইয়েছে, স্বাদ ভালোই – এর পাকা ফল তার মানে খাওয়া যায়। …যাহোক, ঐ পথেই আমরা পাইন্দু খালের তীরে আবার ফেরত এলাম। ট্রেকে ফিরে আসতে পেরে আমাদের ভালোই লাগলো। কিন্তু ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি।

পার হতে না পারায় খালের পাড় ধরেই ট্রেক (ছবি: তানভির)
পার হতে না পারায় খালের পাড় ধরেই ট্রেক (ছবি: তানভির)

কিন্তু পাইন্দু খালের খরস্রোতা জলে আমরা না পেলাম কোনো সেতু, না পেলাম কোনো নৌকা, না কলাগাছেরই কোনো ভেলা। এখন এই খরস্রোতা জল ডিঙিয়ে ওপাড়ের পাড়াটাতে যাবোইবা কিভাবে? সাঁতরে তো যাওয়াই যায়, কিন্তু দলের সবাই সাঁতার জানলেও মোহন সাঁতার জানে না। তাছাড়া সাঁতরে গেলে ব্যাগগুলোর কী হবে? ওগুলো তো জলরোধী না – সব ভিজে যাবে। অগত্যা, আমরা এপাড় ধরেই খালের আপস্ট্রিমের দিকে, মানে উজানের দিকে এগোবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এর মধ্যে তানভির একবার হাফ হাতা পোষাক ছেড়ে ফুলহাতা, আবার কেড্‌স খুলে রাবারের জুতা, কখনও রাবারের জুতা খুলে কেড্‌স পরে নিচ্ছে। এগোতে এগোতে এক জায়গায় শক্ত, ঘাসে ঢাকা জমি থেকে বাধ্য হয়ে খালের পাশে, ধ্বসে পড়া বালুময় মাটিতে নেমে এগোতে বাধ্য হলাম আমরা। আর তখনই…

ব্যাগের ভারেই হোক, কিংবা অন্য কারণেই হোক, মোহনের পা দেবে গেলো। ওর জুতার ফিতা ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো পা। টেনে নিজেকে আগে তুললো বেচারা। তারপর কোনো রকমে জুতা হাতে নিয়ে ও-জায়গা পেরিয়ে এলো। সামনে ছোট আর গভীর ঝিড়ি এসে পাইন্দু খালে নেমেছে, সেটা ডিঙাতে এগিয়ে সংশয়েই পড়ে গেলাম আমরা। আমি আমার ব্যাগসমেত লাফ দিয়ে দূরত্বটা ঘোচাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দিলাম লাফ, ওপারে চলে গেলাম ঠিকই, কিন্তু…

আমার ব্যাগের বাম কাঁধের স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেলো। মোহনকে তাই লাফ দিতে নিষেধ করলাম। ওকে লম্বা করে পা ফেলে এপাশটাতে আসতে বললাম, আর আমি হাতে ধরে টান দিয়ে ওজনটা ভাগাভাগি করে নিলাম। তারপর খালে নেমে মোহন ওর পা, মোজা, আর জুতাটা পরিষ্কার করে দেখলো, নাহ, ভাগ্য ভালো, জুতাটা ছিঁড়েনি, খুলে এসেছে একটা ফিতা। জোরে চাপ দিয়ে ওটা লাগিয়ে নিলো সে। একটু দেরি হলো তাতে, ওদিকে আবু বকর রেগে গেলেন। এতো দেরি কেন? এগিয়ে গিয়ে বললাম আমাদের দুজনের দুরবস্থার কথা।

মনে মনে আবু বকর একটা হিসাব কষে নিলেন, এবং সিদ্ধান্তটাও নিয়ে নিলেন। আমরা আরো এগোলাম। কিন্তু খালের পানিতে সামান্যতম চর কিংবা পার হবার উপযোগী কোনো চ্যানেলই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এখন বিরামহীন পড়ছে। খালে কয়েকজন কিশোর গোসল করছে। আবু বকর তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানলেন, পার হবার মতো কম পানি আরো সামনে। আমরা আরো এগোলাম।

আবু বকর সিদ্ধান্ত জানালেন, “আজকে আর দিনও বেশি বাকি নেই (তখন ৩টা বাজে প্রায়, সন্ধ্যা হয় সাড়ে ৫টায়), বৃষ্টিও আসছে, আমার মনে হয়, আমরা আজকে রাতটা এই পাড়াতেই থাকি।” আমার ব্যাগের একটা ফিতা ছেঁড়া, জলরোধী কোনো ব্যবস্থা কারোরই নেই, বৃষ্টি ইতোমধ্যেই মাথার উপর পড়ছে, পাহাড় আগে থেকেই ভেজা – সুতরাং আমাদের কারোরই এই সিদ্ধান্তে ‘না’ করার মতো কিছুই নেই। কিন্তু এখন খাল পার হবো কিভাবে?

এক জায়গায় গিয়ে দেখা গেল, পাহাড়ি মহিলারা, কিশোর-কিশোরিরা একসাথে গোসল করছে, ওপাশে একটা ঘাটমতোই আছে। ওরা জানালো এদিক দিয়েই কোমর পানি দিয়ে পার হওয়া যাবে। কোমর পানিতে নামলে ব্যাগগুলো মাথার উপরে নিয়ে এগোতে হবে। কিন্তু যে হারে ঘোলা পানির ঢল নামছে, যদি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি, তাহলে ভেসে যেতে হবে, সবকিছু ভিজিয়ে। তাই আবু বকরকে বললাম, আপনি ব্যাগ রেখে একবার নেমে দেখে আসেন, কী অবস্থা। পার হওয়া যাবে কিনা।

আবু বকর ব্যাগ রেখে পাইন্দু খালের কাদাজলের ঢলে নেমে গেলেন। কোমর অবধি ডুবে গেলো তাঁর। আমার আর তানভিরের উচ্চতাও কাছাকাছি, মোহন সামান্য হয়তো লম্বা। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ফিরে এসে জানালেন, যাওয়া যাবে, তবে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। আমি পরামর্শ দিলাম, দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে হাঁটলে ব্যালেন্স পাওয়া যাবে। আবু বকর আর তানভির নিজেদের ছোট ব্যাগগুলো নিয়ে আগে পার হলেন। এরপর আমি আর মোহন নিজেদের ব্যাগগুলো মাথায় করে, আমার ক্যামেরার ব্যাগটা কোমর থেকে খুলে আবু বকরের হাতে দিয়ে নামলাম কোমর পানিতে। নিচের কাদামাটি আর বালির তলায় পা বসিয়ে, পানির ঢলের ঠ্যালা সহ্য করে, মাথায় বোঝা নিয়ে এগোন চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু আমরা ঈশ্বরের কৃপায় সহজেই পার হয়ে গেলাম।

ওপারে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করলাম প্রচুর লোক – নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবা এপাড়ে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেখছে। অনেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, “আপনারা কুথা থেকে আসছেন?” “আপনারা কই যাবেন?”

উত্তর দেবার সময় নাই, আগে তো খাল থেকে উঠি। কোমর পানি থেকে ব্যাগসমেত পাড়ে উঠে এলাম। আবু বকর বললেন, পাড়ায় উঠার যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, উঠার আগে গোসল করে একবারে উঠি। কথা ঠিক। ঐ অবস্থায়ই নিজেদের অ্যাংকলেট, নীক্যাপ, মোজা ইত্যাদি খুলে ব্যাগ থেকে সাবানটা বের করে আবার ঐ ঘোলা কাদাজলের ঢলে নেমে গেলাম গোসল সারতে। ঘামে ভেজা শরীরটা জুড়াতে এই কাদাজলকে অবহেলা করবার মতো ধনী আমরা নই। ডুব, আর সাবান ঘষে দৌঁড়ের উপর কাজ সারতে থাকলাম আমরা। ডুব যখন দেই, তখন তীব্র স্রোত আমাকে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। বেশিক্ষণ থাকলাম না, ঘোলাজলে বেশিক্ষণ থাকলে শরীর জুড়ানোর বদলে কাদায়ই মাখামাখি বেশি হবে।

বেশ কিছুক্ষণ থেকেই পাড়াবাসীর কাছে শুনছিলাম, বোট আসবে, ওটা দিয়ে পার হওয়া যাবে। কিন্তু আমরা বোটের অপেক্ষা করিনি। আবু বকর তাড়া দিলেন, বোট যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। আর বোট এলে আমাদের, গাইড ছাড়াই, এখান অবধি চলে আসার খবর রুমা বাজারে পৌঁছে যাবে – আমাদের তাড়াতাড়ি করা উচিত। আমি আর আবু বকর গোসল শেষ করে ওযু করে পাড়ে উঠে গেলেও মোহন আর তানভির তখনও জলে। তখনই পাইন্দু খালের ভাটি থেকে ভটভট করে বোটের আওয়াজ আসতে থাকলো। দ্রুতই আবু বকর আর আমি ব্যাগ নিয়ে উৎরাই পেরিয়ে পাড়ার দিকে উঠতে থাকলাম।

কিন্তু দুয়েকজন আমাদেরকে, অনেকটা, পথ আগলেই, জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কোথায় যাবো? আমরা এখানে কেন এসেছি? আমরা ওদের পাড়ায় কেন এসেছি? – প্রশ্নগুলোর কোনোটাই আমাদের জন্য সুন্দর না। পাহাড়ের এজীবনে চারজনের অভিজ্ঞতায়ই এই প্রশ্নগুলো বড্ড বেশি বেমানান। বড্ড বেশি আন-ওয়েলকামিং। এরা কোনোভাবেই আমাদেরকে এদের পাড়ায় মেনে নিতে পারছে না।

কোনো সন্দেহ নেই, আজকে এই পাড়ায় থাকার সিদ্ধান্তটা আমাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তই। এরা এটা মেনে নিবে না। এদিকে বোটের ইঞ্জিনের আওয়াজ নিচেই চলে এসেছে। আমি আর আবু বকর সরে আসতে পারলেও মোহান আর তানভির তখনও খালের কাদাজলে সাবান মাখছে…

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*