আমার মায়ের অন্দরসজ্জা

~ স্বল্প খরচে সুন্দর ঘর ~

আমার মধ্যে যদি ক্রিয়েটিভ কিছু থেকে থাকে, তবে সেটুকু পেয়েছি আমি আমার মা থেকে। তিনিই মূলত আমাদের ঘরটা সাজিয়ে রাখেন তাঁর মনের মতো করে। মাঝে মাঝেই তিনি পরিবর্তন আনেন তাঁর সাজিয়ে রাখা ঘরে। সবসময় পরিষ্কার রাখার একটা বাতিকও আছে তাঁর। ফলে সাজানো-গোছানো ঘরটাকেও আরো পরিশিলীত লাগে।

যাহোক, মূল কথায় আসি। টিভিতে আমরা বিভিন্ন সময় ইন্টেরিয়র ডিযাইনবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখি। সেসব অনুষ্ঠানে যেসকল বাড়ি-ঘরগুলোকে উপস্থাপন করা হয়, সেগুলো হয় খুব উচ্চবিত্তের ঘর-বাড়ি। তাঁদের ইন্টেরিয়র বা অন্দরের উপাদানগুলোও হয় জাঁকজমকপূর্ণ। তাই আমরা মধ্যবিত্তরা সেসব দেখে শ্রেফ একটু হা-হু করি, সত্যিকার অর্থে নিজেদের জন্য কোনো সমাধান পাই না। কারণ সেখানে স্বল্প খরচে ঘর গোছানোর কোনো পথ বাতলে দেয়া হয় না। আমরা এই পোস্টে স্বল্প খরচে ঘর গোছানোর বা ইন্টেরিয়র ডিযাইন করার ব্যাপারটি দেখতে পারি, যদি তা আদৌ আপনাদের কাছে অন্দরসজ্জা মনে হয় আরকি। আমার মা ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে যেসকল দর্শন অনুসরণ করেন, তা হলো:

  • ঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা
  • ঘরে, খোলামেলা আমেজ নিয়ে আসা
  • ঘরে, প্রাকৃতিক আবহ নিয়ে আসা
  • ঘরকে ব্যবহারোপযোগী করা

পরিচ্ছন্নতা

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ঘর গোছানোর মূল উদ্দেশ্য বলা যায়। সেক্ষেত্রে তিনি যেসকল উপাদান ব্যবহার করলে ঘরকে পরিষ্কার রাখা যায়, সেসকল উপাদান ব্যবহারের পক্ষপাতি। যেমন, ঘরে কোনো বক্স-খাট রাখার বিপক্ষে তিনি সবসময়। দ্বিতীয়ত, তাঁর দর্শন হলো:

ময়লা রেখে দিয়ে নয়, ময়লা পরিষ্কার করে বলো আমি ময়লা ঘৃণা করি।

সেজন্য ঘরকে সবসময় ঝাড়ু দিয়ে রাখা, ঝুল-ঝাড়ু দিয়ে ছাদের ময়লা পরিষ্কার রাখা, টাইল্‌সের ঘরের ক্ষেত্রে এক-দু মাস পরপরই টাইল্‌সের উপর হারপিক পাউডার আর হ্যান্ড-ব্রাশ দিয়ে যুদ্ধ করা (বিশেষ করে যদি তা সাধারণ গ্লযি বা চকচকে টাইল্‌স হয়) ইত্যাদি পথাবলম্বন করা তাঁর নিত্য কাজ। তাছাড়া ঘরের আসবাবগুলো থেকে প্রতিদিন, হ্যা, প্রতিদিনই কাপড় দিয়ে বা পালকের ঝাড়ু দিয়ে ধুলা পরিষ্কার করাও আরেকটি দৈনিক কাজ।

পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে বক্স খাট আমার মায়ের দুচোখের শত্রু, কেননা তার নিচের অংশটা ঝাড়ু দেয়া যায় না সবসময়, আর সেখানে মাকড়শা আর তেলাপোকার নীরব আবাস গড়ে ওঠে। আরেকটা জিনিস তিনি দুচোখে দেখতে পারেন না, তা হলো কেবিনেট। কেবিনেট মানেই হলো বাক্সবন্দী তেলাপোকার আড্ডাখানা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তিনি রান্নাঘরে কেবিনেট বানিয়েছিলেন এবং এখন তিনি সেজন্য প্রায়ই আক্ষেপ করেন। আর নিত্যদিন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর তেলাপোকা-বিরোধী যুদ্ধ। কখনও ফিনিশ পাউডার, কখনও ফিনিশ চক, কখনও ‘ঝাটার বাড়ি’ তাঁর নিত্যদিনের যুদ্ধের অংশ।

পরিচ্ছন্নতার জন্য আমার মা আরও একটা কাজ করেন, বিছানার বালিশসহ অন্যান্য উপকরণ সারাদিন ঢেকে রাখেন উপরে আরেকটা চাদর দিয়ে। রাতে ঘুমানোর আগে সেই চাদরটা আলগোছে তুলে নিয়ে তারপর মাথা পাতেন বিছানায়। এতে মূল চাদরটিসহ বিছানা থাকে পরিষ্কার আর ধুলাবালিমুক্ত।

খোলামেলা ভাব

ঘরে খোলামেলা আমেজ নিয়ে আসার জন্য আমার মায়ের প্রথম পছন্দ রট-আয়রনের আসবাব। কিন্তু নিজের ঘরে আসবাব থাকাসত্ত্বেয় নতুন আসবাব কিনে অর্থ ব্যয় না করার কারণে তিনি আপাতত কাঠের আসবাবেই আছেন। রট-আয়রনের ক্ষেত্রে নকশার ফাঁক-ফোকর দিয়ে আমাদের দৃষ্টি চলে যায় দেখে, ঐ আসবাব যে কিছুটা জায়গা দখল করে আছে, সেটা আমরা সাধারণত ধরতে পারিনা, তাই রট-আয়রনের ফাঁকা-ফাঁকা গরাদের নকশা করা আসবাব তাঁর পছন্দ।

কাঠের আসবাবের ক্ষেত্রে উঁচু রেলিংওয়ালা খাট আমার মায়ের দুচোখের শত্রু। এসকল খাটগুলো নাকি দৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং ঘরের স্পেসকে কমিয়ে দেখায়, আর ঘরকে আবর্জনাময় লাগে। একইভাবে বক্স খাট, তার নিচের অংশ দিয়ে দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্থ করে, যা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে স্পেসকে কমিয়ে আনে।

খোলামেলা আমেজের জন্য ঘরের রং একটা বড় বিষয়। ঘরে লাল, নীল ইত্যাদি গাঢ় রঙের ব্যবহার দৃষ্টিকে শুষে নেয় এবং তা ঘরকে চোখের সামনে ছোট করে তুলে ধরে। সেক্ষেত্রে হলুদ, হালকা আকাশি ইত্যাদি রঙের কথা বলা গেলেও আমার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের রং সাদা। ঘরের মেঝে, ছাদ, দেয়াল সর্বত্রই তিনি সাদা রংটিকে পছন্দ করেন। সাদা নাকি দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, ঘরকে খোলামেলা দেখায়, আর নিয়মিত পরিষ্কার রাখার মাধ্যমে ঘরকে পরিচ্ছন্নও দেখায়।

খোলামেলা আমেজের জন্য ঘরের আসবাবের রংও গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমার মায়ের প্রথম পছন্দ অটবি’র ফার্ণিচার বা সেরকম রঙের বোর্ডের ফার্ণিচার। কারণ ঐসব আসবাবের গায়ের রংটা সাদার খুব কাছাকাছি। কিন্তু অটবি’র আসবাব এতো দামি যে, সাধারণ মানুষ সবসময় কুলিয়ে উঠতে পারেনা সেরকম আসবাব কেনার দিকে। তাই আমার মায়ের লক্ষ্য থাকে, নিজস্ব আসবাবগুলোকেই যথেষ্ট সাদাটে ভাব দেয়া, আর সম্ভব হলে, প্রয়োজন হলে নতুন আসবাব বানানোর সময় অটবি’র শীট বা মেলামাইন পার্টিক্যাল বোর্ড দিয়ে আসবাব বানিয়ে নেয়া। ঘরের আগের আসবাবগুলোতে সাদাটে ভাব নিয়ে আসার জন্য আমার মা, রং করানোর সময় কাঠের মিস্ত্রিকে নির্দেশ দেন যেন খুব হালকা একটা বার্নিশ দেয়া হয়, যাতে আসবাবে ঔজ্জ্বল্য আসে, কালচে না দেখায় আর কাঠের আসবাবের শানও বজায় থাকে।

এছাড়া জানালা বা দরজার পর্দা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাদাটে রঙের বা ক্রিম রঙের পর্দা আমার মায়ের প্রথম পছন্দ। অবশ্য শানদার, ঐতিহ্যপূর্ণ কোনো নকশাদার পর্দায় তাঁর আপত্তি নেই। জানালা বা দরজার পর্দা যেন খাটো না হয়, এবং উপর থেকে নেমে এসে মেঝের খুব কাছাকাছি পর্যন্ত অবস্থান করে- এতোটা লম্বা পর্দা তাঁর পছন্দ। পর্দা যখন ব্যবহৃত হয় না, তখন তা গুটিয়ে একপাশে রাখার জন্য তিনি পর্দার রঙেরই ঝালর বানিয়ে নিয়েছেন, যা দিয়ে পর্দাকে একত্র করে একপাশে গুটিয়ে রাখা যায়।

নিচু আসবাব ঘরকে খোলামেলা দেখায়। এক্ষেত্রে মেঝেতে পাতা বিছানা সবচেয়ে উপযোগী হলেও তাতে বিছানার নিচটা পরিষ্কার করা যায়না বলে আমার তার পক্ষপাতী নন। সেক্ষেত্রে তুলনামূলক নিচু আসবাব ব্যবহার করার পক্ষপাতি তিনি। বিছানার রেলিংকে একেবারে তোষকের সমান নিয়ে আসা, টেবিলকে নাভি’র উচ্চতা অতিক্রম করতে না দেয়া, চেয়ারকে হাঁটুর উচ্চতার কাছাকাছি নিয়ে আসা তাঁর কিছু কার্যক্রম।

ঘরকে খোলামেলা দেখাতে সংযত আলো’র ব্যবহার তাঁর আরেকটি টুল। সেক্ষেত্রে তিনি লালচে ট্যাংস্টেন বাল্ব পরিহার করে সিএফএল বাল্ব (আমরা যাকে বলি ‘এনার্জি সেভিং বাল্ব’) ব্যবহারের পক্ষপাতি। কোথাও টিউবলাইটের ব্যবহারেও আপত্তি নেই। এলইডি হলে তো কথাই নেই।

ঘরকে খোলামেলা দেখাতে ঘরের নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলোকে গুছিয়ে রাখা আর তার মধ্যকার তুলনামূলক কম ব্যবহার্য জিনিসগুলোকে দৃষ্টির আড়ালে রাখার ব্যাপারটিও তাঁর অত্যন্ত বিবেচনাপ্রসূত একটি ভাবনা। মশারি, কাঁথা, বালিশ ইত্যাদি চোখের সামনে না রেখে বাক্সবন্দী করার পক্ষপাতি তিনি। সেক্ষেত্রে সেই বাক্সকে ন্যাপথলিন বা পোকার ওষুধ দিয়ে পোকামুক্ত রাখাও জরুরি। কম ব্যবহার্য অথচ প্রায়ই লাগে, এরকম জিনিসগুলোকে তিনি কোনো কিছুর আড়ালে রাখার পক্ষপাতি। সেক্ষেত্রে হয়তো তিনি ঐসব জিনিসের সামনে একটা ফুলদানি রেখে দেন, কিংবা একটা ছবির ফ্রেম। তবে অবশ্যই ছবির ফ্রেমে কোনো প্রাণীর ছবি রাখা হয় না, যেহেতু মুসলমান হিসেবে এসকল ঘরে নামায আদায় করা হয়।

বাক্সবন্দী করার ক্ষেত্রে দেয়ালে আটকানো কেবিনেট একটা উত্তম সমাধান হলেও আমার মা এখন তার ঘোর বিরোধী। সেক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ হলো খোলা তাক বানানো, আর তাতে নিচের দিকে একটু উঁচু করে রেলিং বসানো, যাতে জিনিসপত্র দৃষ্টির আড়ালে থাকে, কিন্তু আলো-বাতাস ঠিকই চলাচল করতে পারে।

খোলামেলা দেখাতে দেয়ালে খুব বেশি  জিনিস রাখার বিপক্ষে আমার মা। তিনি দেয়ালে খুব কম জিনিস ঝোলাতে পছন্দ করেন। ঘরে, একটা-দুটো ছোট ফ্রেম, ক্যালেন্ডার, ঘড়ি- এসব ছাড়া পারতপক্ষে বেশি জিনিস ঝুলিয়ে রাখেন না। আর ঘরে রাখার জন্য প্লাস্টিকের ফুল কিংবা গাছগুলোকে বাছাই করেন ছোট আকৃতির।

ঘরের এলোমেলো ভাবটা দূর করা গেলে ঘরকে খোলামেলা দেখায়। এক্ষেত্রে, বইগুলোকে স্তুপাকারে না রেখে খাড়া করে রাখলে সেটা ঘরকে সুন্দর করে। ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি সোজা করে, ভূমি বরাবর উলম্ব করে রাখলে একদিকে যেমন সেগুলো ভালো থাকে, তেমনি গোছানো দেখায়।

প্রাকৃতিক আবহ

প্রাকৃতিক আবহ মানে শ্রেফ আবহই না, কিছুটা প্রকৃতিও বটে। সেক্ষেত্রে আমার মা অনেকটা পরিবেশবান্ধব। তিনি তাঁর বারান্দা জুড়ে টবে লাগিয়েছেন গাছ। গাছ কেনা, গাছের পরিচর্যা করায় তাঁর বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের বারান্দায় সূর্যের আলো সরাসরি খুবই কম আসে। তাই তিনি সব ধরণের গাছ চাষ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেক্ষেত্রে ছায়ায় বাঁচে এমন, বিশেষ করে মানিপ্ল্যান্ট, একপ্রকারের কচুগাছ, আর নাম-না-জানা কীসব কয়েকটি গাছ যেন চাষ করছেন। মাঝখানে ক’দিন কয়েকটা টবে পুঁইশাকও চাষ করেছিলেন। পুঁইশাক চাষ খুব সহজ: বাজার থেকে কিনে আনা পুঁইশাকের পাতা ছাড়িয়ে তার ডাটাগুলো মাটিতে পুতে দিলেই ক’দিনের মধ্যে কুড়ি গজায়।

এছাড়াও বাথরুমে, এবং কখনও ঘরের ভিতরে একটা-দুটা প্রাকৃতিক গাছ তিনি লাগিয়ে রাখেন। সেগুলোকে আবার মাঝে মাঝে বারান্দায় নিয়ে আলো-বাতাস খাইয়ে আনতেও তাঁর অনীহা নেই।

প্রাকৃতিক আবহের বেলায় আমার মায়ের জুড়ি নেই। গাছ আর ফুল দেখলেই পাগল। প্লাস্টিকের গাছ আর ফুল দিয়ে ঘরটা ভরিয়ে রাখা তাঁর প্রধানতম শখ। মার্কেটে যান আর বাণিজ্যমেলায়ই যান না কেন, ফুল যে তিনি কিনে নিয়ে আসবেন, সেটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। সেই সব ফুলকে রাখা হয় দৃষ্টিনন্দন সব টবে বা ফ্লাওয়ার ভাসে। এমনকি সিঁড়িঘরে পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছেন সেরকম ভাস, কিন্তু কোনো এক তষ্করের যন্ত্রণায় সেখানে ফুল রাখাই দায়- মাঝে মাঝেই সে ফুল চুরি করে পগার পার। তাকে ঠেকানোর জন্য একবার ফুলের উপর বালি ছড়িয়ে দেয়ার বুদ্ধিও যখন ফেল করলো, তখন খুব সাদামাটা ফুল রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না আমার মা।

ব্যবহারোপযোগী করা

ঘরকে ব্যবহারোপযোগী করার ক্ষেত্রে ঘরে প্রয়োজনীয় আসবাবের সম্মিলন ঘটানো একটা বড় ব্যাপার। সেক্ষেত্রে নকশাদার জিনিসপত্র না বাড়িয়ে ঘরের আসবাবগুলোকেই এমনভাবে নকশাদার করে বসানো, যাতে ঘরকে নকশাময় মনে হয়, আবার ঘর ব্যবহারোপযোগীও থাকে।

ঘরকে সাজানোর ক্ষেত্রে আমার মায়ের সবচেয়ে বড় যে দর্শনটা আমি দেখি, তা হলো:

ঘর গোছাতে দাসী হয়ে যাও, আর রাণীর ঘর পাও।

এছাড়া, সামর্থের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সুন্দর দৃষ্টি। অনেক ক্ষেত্রে খুব সস্তা জিনিস দিয়ে ঘরটাকে এতো সুন্দর করা যায়, ভাবাই যায় না। যেমন সেদিন একটা কাচের ফুলদানি কিনে আনলেন, যে জিনিসটা দেখলে কল্পনাই করা যায় না, মাত্র ৬০ টাকার একটা ফুলদানি এতো সুন্দর লাগতে পারে। আমার বোন একটা ছোট্ট ক্ষুদে জুতা কোথা যেন কিনে নিয়ে এসেছে মাত্র ২০ টাকায়, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জুতার বাক্সের উপরে রাখা ঐ জুতা-জোড়া যে-কারো কাছেই প্রচণ্ড আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

আর মধ্যবিত্তের ঘরের সবচেয়ে বড় শক্তিটা হলো ছোট ঘর। আমার এক খালার আক্ষেপ হলো, আমাদের ঘরে খুব ছোট জিনিসটাও চোখে পড়ে, অথচ তাঁর ঘরে সেগুলো দেখাই যায় না। তাই ছোট ঘর, ছোট ছোট জিনিস দিয়েই সাজিয়ে ফেলা যায়, খুব সুন্দর করে।

অন্দরসজ্জার ঝক্কি-ঝামেলা

ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বা অন্দরসজ্জার এতো এতো কথা বললাম, যেগুলোর কোনো কোনোটা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ঝক্কি-ঝামেলাও আছে। যেমন:

  • ব্যবহার্য জিনিসগুলোকে দৃষ্টির আড়ালে নিতে কেবিনেট বা আবদ্ধ বাক্স বানালেই সেখানে পোকামাকড় আর তেলাপোকার আস্তানা হয়। তাই নিয়মিত, আবার বলছি, নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রম আর পোকারোধী ঔষধের ব্যবহার কাম্য।
  • চোখের আড়ালে জিনিস নিতে আপনি যখন জিনিসগুলোকে খাটের নিচে, ফ্রেমের আড়ালে রাখবেন, তখন মাঝে মাঝেই, কিংবা নিয়মিতভাবেই সেগুলো আড়াল থেকে বের করে পরিষ্কার করতে হবে। নাহলে মাকড়শার অভয়ারণ্য বনে যাবে।
  • সাদাটে ঘরে একটা ছোট্ট দাগ, কিংবা মশা মরা রক্ত লেগে থাকলেও তা দেখা যায়। তাই ঘরে ছোট্ট বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে সেটা মেইনটেন করা কষ্টসাধ্য। তাছাড়া ধুয়ে ফেলা যায় এমন ডিস্টেম্পার দিয়ে দেয়াল রং করা সবার সাধ্যে কুলায় না।
  • সাদাটে রঙের আসবাব খুব দ্রুত ময়লা দেখায়। তাই নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান (কখনও ফার্ণিচার শাইনার দিয়ে, কখনও কেরোসিন দিয়ে) অবশ্যই চালাতে হয়। কাচের আসবাব মোছার জন্যে গ্লাস ওয়াশার লিকুইড কেনার প্রয়োজন পড়ে, কিংবা কখনও চক পাউডার দিয়ে কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ মোছন-অভিযান চালাতে হয়।

তারপরও মনে রাখতে হবে, যদি সুন্দর ঘর কাম্য হয়, তবে তা করার জন্য সম্ভাব্য সব কার্যক্রমই নিয়মিত করতে হয়। ঘরে, কোণায় কোণায় আলো নয়, দামি দামি আসবাব নয়, বরং সৌখিন দৃষ্টিকোণ প্রয়োগ করতে হয়।

এতো এতো বড় বড় কথা যার থেকে নিয়ে বলছি, তিনি নিজে এবিষয়ে কোনো পড়ালেখা করেননি, শ্রেফ পর্যবেক্ষণজাত স্বীয় জ্ঞান এসব। হয়তো কোনো ইন্টেরিয়র ডিযাইনার এসব পড়ে হাসছেন। হয়তো তিনি এই সামান্য একজন নারীর “ইন্টেরিয়র ডিযাইনিং” -নামটিকে-অপমানসূচক-প্যাঁচাল দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠছেন। কিন্তু সত্য কথা হলো, যার সম্বন্ধে এতো কথা বললাম, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। তিনি আছেন তাঁর ঘরকন্না নিয়ে, কিভাবে রান্না করবেন, কিভাবে বুয়াকে ম্যানেজ করবেন, কিভাবে ঘর গোছাবেন, কিভাবে সময়মতো আবার নামাযটা পড়ে নিবেন, কিভাবে গোসল করে আবার একটু সুগন্ধি মেখে ফুরফুরে ভাব নিয়ে ঘুমুতে যাবেন… এভাবেই চলতে থাকে তাঁর প্রতিদিনের ব্যস্ততা।

আমি শ্রেফ তাঁর কাজে মুগ্ধ হই বলেই আমার উপলব্ধি থেকে এই লেখাটি লিখলাম। হয়তো এখানকার অনেক কথাই তাঁর মনের কথা না, আমার পর্যবেক্ষণজাত মনের কথা। তবে আর যাই হোক, তিনি ভালো নকশা করুন আর নাই করুন, তিনিই আমার ঘরের ইন্টেরিয়র ডিযাইনার। সবার ভালো লাগুক এমনটাই তাঁর কামনা, যদিও অতৃপ্তদের তৃপ্ত করা যায় না।

আমার মায়ের আরেকটা দর্শন আমার কাছে ধর্তব্য মনে হয়:

মনটাকে বড় কর, ঘরটা বড় হয়ে যাবে।

মা, এই পুরো পোস্টটা আমি তোমাকে উৎসর্গ করলাম।

-মঈনুল ইসলাম

৪ thoughts on “আমার মায়ের অন্দরসজ্জা

  1. >বন্ধু, খুবই মজা পেলাম পোস্টটা পড়ে! আর তোর বাসাটাও আমার পছন্দ হয়েছে। আন্টিকে বলিস, তার "ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং" সেন্স আমার মনে ধরেছে। কারণ কোন না কোন ভাবে আমার মায়ের চিন্তাধারাও এখানে মিলে যায়। যদিও এখন শারিরিক অসুস্থতা আর বয়সের কারণে আগের মত খেয়াল করতে পারেন না। কিন্তু আমার মা আমাদের ঘর গোছানো থেকে শুরু করে আমাদের খাবার সময় পর্যন্ত কড়াভাবে মেইনটেইন করতেন। যাই হোক, আন্টিকে শুভকামনা। ভালো থাকিস।

  2. মঈনুল ভাই, আমি অনেকদিন থেকেই আপনার লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। এই চমৎকার লেখাটি কিভাবে আমার দৃষ্টি গোচর হল না তা বুঝতে পারছিনা। অসাধারন সব আইডিয়ার খোঁজ পাওয়া গেল লেখাটি থেকে। আন্টিকে আমার শুভেচ্ছা ও ছালাম জানাবেন। আমি এবং আমার স্ত্রী ও আমাদের ছোট্ট বাসাটি যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আপনার লেখা থেকে অনেক আইডিয়া পাওয়া গেল। আমাদের বাসার কিছু ছবি আমি আপনার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারএ পাঠিয়ে দিব। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান (2022) অশান্ত পরিস্থিতির উপর কিছু লেখা আপনার কাছে আশা করছি। সাথে কেউক্রাডং এর পর কেন জাদিপাই ঝর্নার যাবার পথ বন্ধ আছে সে বিষয়ে কিছু করা যায় কিনা দেখবেন।

  3. মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর লেখনী শক্তি আপনার। সত্যি আপনি এমন মা পেয়েছেন যে কিনা এ বিষয়ে কোনও শিক্ষা ছাড়াই এতো সুচারু আর সুনিপুণ চিন্তা ও প্রকাশ উনার। এতো বছর আগেই উনার এতো আধুনিক ও রুচিশীল মনভাব! এতো বছর পর এই সময় এসেও অনেক কিছু শেখার আছে উনার থেকে। আল্লাহ পরিপূর্ণ সুস্থতার সাথে নেক হায়াত দান করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*