ধারাবাহিক: অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান —এর একটি পর্ব
সেনাবাহিনী ৬টার সময় থানচির পথ বন্ধ করে দিলেও ঈশ্বরের অনেক কৃপায় আমরা ছাড় পেলাম। কিন্তু মনের আনন্দে এসে ধরা পড়লাম বলিপাড়া বিজিবি ক্যাম্পে। ৯জন ছেলের সাথে একটা মেয়ে বিশেষ সন্দেহজনক এবং ঘোলাটে ব্যাপার। সেই ঘোলাজল পরিষ্কার করবার দায়িত্ব ছিল খুদ দুবারাহ’র উপর, কিন্তু সে যখন জানালো তার গার্জিয়ানরা সব এ্যামেরিকায়, তখন আর কোনো পথ খোলা থাকলো না।
দিবারাহ জানালো, সে এ্যামেরিকায় থাকে, এখানে ইনটার্ন করতে এসেছে। চেহারার কুশ্রী বাকা হাসি এবারে আকর্ণ বিস্তৃত হলো বিজিবি জোয়ানের। আরো পেয়ে বসলো তারা: ‘এটা আমেরিকা না’। এই মেয়েটাকে বাংলাদেশের নিয়ম-কানুন শেখাবার উপযুক্ত সুযোগ পেয়েছে তারা। ‘এতোগুলো ছেলের সাথে একা এভাবে পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো – এটা কোনো নিরাপদ জায়গা না।’ বলে শুরু হলো কবে কখন কারা এখানে কিডন্যাপ হয়েছে, কবে কখন কোন নারীর অবমাননা হয়েছে, কবে কখন কাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে…
…ঢাকায় কে থাকে আপনার? …তেমন কেউ না। …কার সাথে থাকেন? দিবারাহ যা যা উত্তর দিচ্ছিলো, দলের কেউই সেগুলো আশা করছিলো না: দিবারাহ ঢাকায় কোনো এক ভাইয়ের বাসায় থাকে, সেখানে তাঁর দাদী অথবা নানী কেউ একজন থাকেন, যাকে সে কোনোভাবেই এখান থেকে ফোন দিতে চাইছে না, তিনি দুশ্চিন্তা করবেন। অবশেষে সে ইফতি’র ফোন নিয়ে (কারণ ঐ একটা ফোনেই নেটওয়ার্ক আছে আমাদের) ঢাকায় এক ভাইকে ফোন দিলো। ফোনটা এগিয়ে দিলো বিজিবি জোয়ানের দিকে।
ওপাশের কথা শুনে, হাদিস-কোরান-মহাভারত আবার কতক্ষণ আওড়িয়ে মোক্ষম প্রশ্ন করলো এবারে জোয়ান: আপনি কি ওনার আপন ভাই? … নীরবতা … না না আপনি কি ওনার আপন ভাই? … নীরবতা … জোয়ানের হাসিটা বড্ড বেশি বাঁকা হয়ে যাচ্ছে … লক্ষণ ভালো না মোটেই … না না, এভাবে পার্মিশন দেয়া যাবে না। আপনি আপন ভাইও নন, কোনো লিগ্যাল গার্জিয়ানের সাথেও কথা বলা যাচ্ছে না। না না ভাই, এভাবে হবে না। এটা পাহাড়, এখানে সমতলের নিয়ম চলে না। ফোন ফিরিয়ে দিলেন জোয়ান।
আমি নিশ্চিত, ঘটনাচক্রে আমার চেহারার অবস্থা যা হয়েছে, বাকিদের সবারই ঘটনা একই। দিবারাহ সম্পর্কে আমরা কেউই এতোটা জানতাম না। জানতাম না এভাবে সামান্য একটা বিষয় এতোটা রঙিন হয়ে পড়বে।
জোয়ান অনন্যোপায় হয়ে সবাইকে বললেন, ‘আপনারা নিজেদের নাম-পরিচয় লিখেন এখানে। স্যার আসতেছেন, উনি দেখবেন বিষয়টা।’ সবাই [সাথে থাকাসাপেক্ষে] নিজেদের ভিযিটিং কার্ড দিলো, নাম-ঠিকানা লিখলো। মনে মনে ভাবলাম, যদি এখান থেকে এখন বাসায় ফোন করে বলা হয় আমি বান্দরবান বিজিবি ক্যাম্প থেকে বলছি, বাসায় আব্বাও নেই, আম্মা আর বোনের তো আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে।
নাম-ঠিকানা লিখে শেষ করতে না করতে জোয়ান দিবারাহকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন: আপনার ধর্ম কী? ব্যস, বারুদে আগুন দেয়ার মতো ঝলসে উঠলো দিবারাহ: ধর্ম আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, এটা কেন আমি ডিসক্লোজ করবো? …নিতান্ত একজন সাধারণ বিজিবি জোয়ান তার সারা জীবনেও কাউকে নিজের ধর্ম গোপন করতে দেখেনি, বাংলাদেশে একজন পেইগানেরও পরিচয় আছে “মালাউন” হিসেবে। কিন্তু এই পুচকে মেয়ে যে এভাবে ধর্মের প্রশ্নে সেনসিটিভ হয়ে উঠবে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি বিজিবি জোয়ান, কিংবা স্বপ্নেও দেখেনি ধর্মের প্রশ্নের উত্তরটা ‘মুসলমান’ ‘হিন্দু’ ‘বৌদ্ধ’ ‘খ্রিস্টান’ ইত্যাদির বাইরে এরকম কিছু হতে পারে।
দিবারাহ এমন এক সমাজে বড় হয়েছে যেখানে আদালতে শপথ নেয়া হয় “ইন দ্যা নেম অফ গড উই বিলিভ”, অথচ বাংলাদেশে আমরা শুরু করি “পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ’র নামে”। ঈশ্বর আমাদের কাছে বড্ড বেশি নির্দিষ্ট, সেখানে দিবারাহ তার স্বীয় ঈশ্বরের (সংশয়ীদের ঈশ্বর) উপাসনা করতে পারে – সেটা আমি নয়ন বুঝলেও ঐ সাধারণ জোয়ানের পক্ষে চিন্তা করাও দুঃসাধ্য ছিল। …তবে ধর্মনিরপেক্ষতার এই আলোচনা বোধহয় মজারু হয়, যদি জানি ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা আব্রাহামীয় ঈশ্বরপূজ্য “বাইবেল” নিয়ে শপথ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্সী শুরু করেন।
দিবারাহ’র জ্বলে উঠায় আমি কিছুটা শংকিত হলাম, এই ছুতায় না আবার আমাদের আটকে দেয় ব্যাটারা। শান্ত করতে চাইলাম দিবারাহ-কে সবাই-ই। দিবারাহ’র স্পষ্ট উত্তর: আই অ্যাম নট ব্লেইমিং দেম। আই অ্যাম রেসপেক্টিং দেম। আই অ্যাম জাস্ট ওয়ান্ডারিং হাও ডেলিকেট আই অ্যাম এয অ্যা গার্ল ইন অ্যা মেইল ডমিনেটেড ওয়ার্ল্ড লাইক দিস।
আমরা আবারো শান্ত করতে চাইলে দিবারাহ জানালো: নো নো, আই অ্যাম নট ব্লেইমিং দেম। দে আর ডুয়িং দেয়ার ডিউটি। আই অ্যাম টোট্ট্যালি রেসপেক্টিং দেম।
দিবারাহ’র জ্বলে ওঠা বিষয়টাকে অন্যরকম মোড় এনে দিলো। আমি তাই অবস্থা শান্ত করতে সবাইকে নিচে চলে যেতে বললাম, দিবারাহসহ। ও’ যতক্ষণ এখানে থাকবে ওর মেজাজ খারাপ লাগবে আর রাগের মাথায় কিছু একটা বলে বসবে। উপরে থাকলাম আমি, নাকিব আর ইফতি।
ইতোমধ্যে নিচে চলে এলেন বড় স্যার। আমিও নিচে চলে গেলাম। তিনি প্রথমে দ্বিতীয় দলটাকে দেখলেন, বললেন এরকম পা নিয়ে সোজা হয়ে হাঁটা যায়, এখন বান্দরবান গিয়েও কোনো ডাক্তার পাবেন না। এখানে বলিপাড়া থাকেন, সকালে চলে যাবেন। টিলার দিকে ঘুরতেই এক জোয়ান কানের কাছে দিবারাহ’র কথা বললো, মেয়ে ইংরেজিতে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। বড় স্যার বলে উঠলেন: ইংলিশে হাংকিপাংকি করলেই তো হবে না। এটা এমেরিকা না।
আমি তাঁর সাথে আঁঠার মতো লেগে রইলাম চেকপোস্ট অবধি। অবশেষে আমাদের ডেকে নিয়ে কথা বললেন। খুব লম্বা কথা বললেন না: পাহাড়ের থ্রেটগুলো জানিয়ে দিলেন, বললেন এভাবে বের হওয়া আমাদের উচিত হয়নি। খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভাই, আপনাদের বিপদ হলে আমাদেরও খারাপ লাগে। এজন্য আমরা এভাবে রিস্ক নিয়ে পার্মিশন দেই না। …আপনারা থানচিতে থাকবেন কোথায়? আমি জানালাম, এখনো জানি না। গিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। …ওখানে যেতে যেতে তো ১০টা বেজে যাবে। গিয়ে দেখবেন বাজারের সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়িরা আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়ে।
ব্যস আমি সুযোগ পেলাম। স্যার, আপনি পার্মিশন দিলেই আমরা রওয়ানা করবো। এজন্যই একটু তাড়াহুড়া করছি। আমরা কি যেতে পারি? …হ্যা হ্যা, আপনারা যান।
অনেক ধন্যবাদ দিয়ে হাত মিলিয়ে দৌঁড় দিলাম তিনজনই। আর এক সেকেন্ডও দেরি করা যাবে না। দ্রুত গাড়ি ছেড়ে দিলেন সুজন ভাই। বিশাল এক ঝড়ের যেন অবসান হলো। সবাই-ই খানিকক্ষণ চুপ।
দিবারাহ-প্রশ্নে বিজিবি’র মতো আমিও বেশ শংকিত ছিলাম। আমি জানি এই দলটা সুসভ্য একদল ছেলের, এরা সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি প্রত্যেকটা মানুষ ঠিক যতটা ভালো, ঠিক ততটাই খারাপ। য়িন-য়িয়াং, পাহাড়ের একপাশ যখন আলোকিত, অন্য পাশ তখন অন্ধকার। সুতরাং আমি নয়ন, এই দাড়িওয়ালা নয়নও আনপ্রিডিক্ট্যাবল। মানুষের সেই লুকিয়ে থাকা পশুটা বের হতে মুহূর্ত লাগে, আর দুর্ঘটনাও ঘটতে লাগে মুহূর্ত। তবু বিশ্বাস করি আলো আসবেই…।
দিবারাহ’র এই ঘটনায় আর-কিছু হোক না হোক, আমরা পাহাড়ের দুর্গম বিপদসংকুল পরিবেশে বড্ড বেশি জোটাবদ্ধ হয়ে গেলাম এবং দিবারাহ-কে রক্ষার ব্যাপারে সক্রীয় হয়ে উঠলো ৯টা তরুণ তাজা মন।
পরিস্থিতি হালকা করলো আবির: সে বললো তার বাসার ঠিকানার জায়গায় সি ব্লকের জায়গায় দিয়ে এসেছে ডি ব্লক। শুনে হাসির রোল উঠলো সবার মাঝে। ঢাকায় ফিরে দিবারাহ আমায় বলে কি, তার বাবা-মা সবাই-ই এখন ঢাকায় থাকেন। সে মিথ্যা বলেছে বিজিবিকে। এখন বুঝতে পারছি: আমি যখন গাড়িতে বললাম, ‘যখন বিপদে পড়বে সত্য বলবে, একমাত্র সত্যই পারে বিপদে রক্ষা করতে’, তখন কেন রাসেলের পাশাপাশি দিবারাহও আমার কথা মানতে পারেনি।
তবে এখানে একটা বিষয় প্রমাণ হয়ে গেল: এই পুরো দলের মধ্যে আমিই চরম বোকা; নিজের সত্য ইতিবৃত্ত দিয়ে এসেছি। তবুও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে বলি: আমি সত্য বলেছি। আমি তা-ই বলি, যা আমি নিজে করি।
রাত যখন ১০টা, একটা ব্রিজ পেরিয়ে সুনসান অন্ধকার বাজারের ভিতরে ঢুকলো আমাদের গাড়ি। ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো থানচি বাজার। গাড়ি থামলো অন্ধকার এক গাছের তলায়। পকেট থেকে টর্চ বের করে দেখার চেষ্টা করলাম আশপাশটা। নামতেই কয়েকজন লোক ঘিরে ধরলো আমাদেরকে। দ্রুত নির্দেশ দিলাম: নাকিব আর ইফতিকে বললাম খাবার আর থাকার ব্যবস্থায় চলে যেতে। ড্রাইভার সুজন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আমাদের ধাতস্থ হতে সময় দিতে। তাঁকে ৳৬,৫০০ [টাকা] বুঝিয়ে দোয়া চেয়ে আন্তরিকভাবে বিদায় নিলাম আমরা। রাসেল আর আমি কথা বলতে থাকলাম ঘিরে ফেলা লোকগুলোর সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝে ফেললাম, নাফা খুমের দিকে যেতে হলে এখান থেকে একজন গাইড নিতে হবে, আর রেমাক্রি গিয়ে নিতে হবে আরেকজন গাইড। ইশারায় বুঝে নিলাম, দুই জায়গার গাইডের মধ্যে একটা চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। আরো একটা বিষয় জানা হয়ে গেলো, এখান থেকে নড়ার উপায় হলো বোট বা ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করা। …এদিকে আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে এদেরই দুজনের মধ্যে লেগে গেলো চরম ঝগড়া – ঠ্যালা সামলাও, কিসের মধ্যে কী। তাদেরকে পিঠে হাত বুলিয়ে, বুকে জড়িয়ে থামিয়ে কোনোরকমে কেটে পড়লাম দুজনে। ইফতি আর নাকিব পাশেই অন্ধকারে ডুবে থাকা একটা হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা করেছে। সেখানকারই এক বাবুর্চি ঘরাণার ব্যক্তি থাকারও একটা জায়গার ব্যবস্থা করেছেন, তারা সেটা দেখেও এসেছে। খাবারের ব্যবস্থা হলো বন্ধ-প্রায় হোটেলটিতে। কুপি জ্বালিয়ে অন্ধকার বিদূরণের ব্যর্থ চেষ্টা। খাবার মেনু হিসেবে জুটলো মুরগীর মাংসের তরকারি। খেতে বসে মনে পড়লো সারাদিন কিছু খাইনি আর। গপাগপ গিললাম। পাহাড়ের রান্নায় ঝাল আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য, আগেরবার এসে শিখেছি; এখানেও সেটা পেলাম। সবাই উফ-আফ করলেও খেয়ে নিলো। (রাতের খাবার সাকুল্যে ৳৭২০)
পেটপূজো শেষ করে এগিয়ে আসা একজনের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম আমি আর রাসেল। নিজেকে সে পরিচয় দিলো গাইড হিসেবে। পকেট থেকে ম্যাপ বের করে পথ দেখিয়ে জানতে চাইলাম সে নিয়ে যেতে পারবে কিনা। এই আলোচনা চলছিলো, এমন সময় নাকিব কী এক জরুরি কারণ দেখিয়ে আমাকে রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে বের করে আনলো। সেখানে দেখি ঐ বাবুর্চি লোকটি কথা বলতে চাইলেন আমার সাথে, জানালেন: এর সাথে কথা বলেন কেন? এ তো ড্রিংক করে আসছে। আপনারা এখন ঘুমান। সকালে আসেন, আমি আপনাদের গাইডের ব্যবস্থা করে দিবো। তাড়াহুড়ার কিছু নাই।
যা বুঝার বুঝে নিলাম। দ্রুত গিয়ে রণে ভঙ্গ দিলাম। রাসেলকে সরিয়ে আনতে বললাম, সবাই এখন ঘুমিয়ে যাবে প্রচন্ড টায়ার্ড; আপনি সকালে আসেন, আমরা তখন কথা বলবো।
আমাদের থাকার জন্য যে জায়গাটা পাওয়া গেল, তার বর্ণনা না করলেই নয়: একটা বাঁশের বেড়ার ঘর, যার অর্ধেকটা একটা বেড়া দিয়ে আলাদা করা, আর সেই অর্ধেকটাতেই থাকতে হবে আমাদেরকে। এই অর্ধেক কোঠাও সাকুল্যে ৮ ফুট বাই ৪.৫ ফুট। একটা ছোট্ট চৌকিই ঘরের সবটা জোড়া। ঘরের ভিতর সবাই ঢুকলে দাঁড়াবারও জায়গা হয় না। দরজা দিয়ে ঢুকলে সামনেই চৌকি, চৌকি ছাড়া বাকি অংশটুকুতে বামদিকে একটা চুলা, ডানদিকে ট্রাংক-ঝুড়ি ইত্যাদি রাখা।
ইফতি দায়িত্ব নিলো এবারের ম্যানেজমেন্টের। বললো একে একে পা পরিষ্কার করে বিছানায় উঠে যেতে। বাইরে পলিথিন-ঘেরা একটা বেশ ভালো মানের টয়লেট পাওয়া গেল (পাহাড়ে এর চেয়ে ভালো টয়লেট আশা করা বৃথা)। সেখানেই সবাই কৃতকর্ম শেষ করে বিছানায় এলো। ইফতি সবার ব্যাগগুলোকে বিছানার সামনেই ট্রাংক-ঝুড়ির অংশটিতে স্তুপ করে রাখলো, সবাই জুতা খুলে চৌকিতে উঠলো।
নাকিব আর ইফতি দেখলাম রাতে পালা করে ঘুমিয়ে পাহারা বসানোর কথা বলছে। আমি ‘লাগবে না’ বললে ইফতি যখন ‘লাগবে বন্ধু’ বললো, বুঝে নিলাম ওরা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। সত্যি বলতে কি, কার ঘরে থাকছি তার সাথে পরিচয় আমার আগে ওদের হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত বিছানার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে গুটিশুটি মেরে দিবারাহ, তার গা ঘেষে আবির, তার গা ঘেষে নাকিব, এভাবে শান্ত, দানিয়েল, রাসেল, ইফতি আর আমি। ওরা সবাই পা বাঁকা করে শুলে পায়ের কাছে ছোট্ট একটু জায়গা পাওয়া যায়, ওখানে শু’লো তরুণ। রইলো বাকি ১: প্রভা ঠিক করলো নিচে, দরজার গায়ে ব্যাগ দিয়ে হেলান দিয়ে সে ঘুমাবে। এতে ঘর পাহারাও হবে, ঘুমও হবে। পালা করে পাহারা দিতে হবে না।
শোবার আগ মুহূর্তে ঘরের মালিক খইশামু মারমা ঘরে ঢুকে একটা বোতল খুঁজতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগে বাইরে সে আমাকে মদ খাবার প্রস্তাব করেছে। আমি জানি, আমাদের সমাজে মদ চরম ঘৃণিত বস্তু হলেও পাহাড়িদের কাছে এটা প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকার অংশ। তাই আশ্চর্য হইনি, তাকে বলেছি, আমি খাই না, দাদা। …এখন বোতল কোথায় পাই? ইফতি অবশেষে সকালে পানির বোতল কিনে নেবার ইচ্ছায় একটা বিনামূল্যে দিয়ে দিলো তাকে। সেও এর জন্য বিনিময় দিতে উদ্যত হলে আমরা সবাই সন্তুষ্টচিত্তে মানা করে দিলাম।
ব্যস, দরজা লাগিয়ে… এহ্হে, দরজা লাগাতে গিয়ে আবিষ্কার হলো দরজা তো লাগানোর কোনো উপায় নেই। একটা বাঁশের চাটাইয়ের দরজা এটা, যা কোনো রকমে ভেজিয়ে রাখা হয়। শেষে একটা কাঠিতে রশি গুঁজে তা বেড়ার গায়ে সেঁটে আটকালো প্রভা। এবারে প্রভা তার পযিশন নিয়ে শুয়ে পড়লো। আমরা সারাদিনের হিসাব-নিকাশগুলো শেষে আমি এশার নামাযটা শেষ করে নিতে চাইলাম জায়গায় বসে। ঘরে ঢোকার আগে দিক চিনেছিলাম সপ্তর্ষিমণ্ডল ধরে ধ্রুবতারা (নর্থস্টার, পোল স্টার) দেখে; থানচি বাজারের রাস্তাটা পাক্কা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। …নামায শেষ, এমন সময়… দরজা খোলার চেষ্টা…
কে?
খুলেন। আওয়াজ শুনে বুঝলাম এটা খইশামু মারমা। বোঝা গেল, তার কিছু একটা দরকার। দরজা পুরোপুরি খোলা গেলো না, কারণ নিচে বস্তা বিছিয়ে প্রভা শোয়ার ব্যবস্থা করেছে। কোনো রকমে ফাঁক করলে সে জানালো ভিতরে একটা দা আছে, ওটা লাগবে তার।
আতঙ্কিত হলাম:“দা!”এই ব্যাটা এত রাতে দা দিয়ে কী করবে?
তাকিয়ে দেখি আমি যেপাশে শোয়ার জায়গা করেছি, সেখানে বাঁশের বেড়ার গায়ে দুটো দা গোঁজা। একটা বের করে দিলাম ওর হাতে। আর ডিসটার্ব করতে মানা করে প্রভা আবার দরজা আটকিয়ে শুয়ে পড়লো।
আমিও শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। নিজের শীতের পোষাকগুলো পরে নিয়ে চিংড়ি মাছের মতো বাঁকা হয়ে ত্রিকোণাকৃতি হয়ে শু’লাম ইফতির গা ঘেষে। ইফতি আর আমার মাথার নিচের বালিশ হলো একটা চালের বস্তা। সবার উপরে গায়ে দেয়ার উপযোগী একটা পরিষ্কার, উষার লাগানো লেপ জুটেছে এটা কম ভাগ্যের কথা না। তবু, এ টান দিলে ওর টান পড়ে, ও টান দিলে এর গা উন্মুক্ত হয়ে যায়। শীতও প্রকট এখানে।
সবাই শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবার কথা বন্ধ হয়ে গেলো। প্রচন্ড পরিশ্রান্ত সবাই, ঘুমিয়ে পড়েছে, প্রভা ঘাঢ় বাঁকা করে শুয়েছে কোনো রকমে, নিচে, ওর গলায় ভাঁজ পড়ায় নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের বেড়াতে অনেক ফাঁক, সেদিক দিয়ে শুক্লপক্কের চাঁদের প্রায় সবটুকু আলোই যেন নিংড়ে পড়ছে ঘরের ভিতরে।
বাইরে হাঁস ডাকার আওয়াজ হচ্ছে, আমার আর ইফতি’র কান খাড়া হয়ে গেল। এতো রাত্রে হাঁস থাকবে ঘরের ভিতর হাঁস ডাকার আওয়াজ আসার একটাই কারণ কেউ একজন আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে। কে সে?
এমন সময় আবার দরজা খোলার চেষ্টা। সাথে সাথে উঠে পড়লাম আমি স্প্রিংয়ের মতো। দরজার মাঝ বরাবর রশি দিয়ে আটকানো হলেও উপরের দিকটা অনায়াসে ধাক্কা দিয়ে যথেষ্ট ফাঁক করে ফেলা যায়। হাতেই রাখা ছিলো টর্চ, সাথে সাথে জ্বেলে দেখি, ওদিক দিয়ে ভিতরে ঢুকে আছে দা ধরা একটা হাত!
কথা শুনে বুঝলাম খইশামু আবার এসেছে দা রেখে যেতে। এমনভাবে দা-টা ভিতরের দিকে ধরা, শুধু যদি হাত থেকে ফসকায়, নিচে শুয়ে থাকা প্রভা জবাই হয়ে যাবে। প্রায় দৌঁড় দিয়েই যেন উঠে গেলাম দরজার কাছে, আগে দা-টা ধরলাম। দা ধরতে না ধরতেই ভিতরে বাড়িয়ে দিলো দুটা জ্যান্ত হাঁস, নিচে রাইখা দেন।
শেষ পর্যন্ত আপদ বিদায় করতে ওগুলোকে মুক্ত অবস্থায়ই চৌকির নিচে, অপ্রশস্থ জায়গাটাতে ছেড়ে দিলাম, এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। আর এভাবে ঝামেলা করতে ‘না’ করে দিয়ে দরজা আবার ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করলাম। প্রভা ঘুমিয়েই আছে।
আবার এসে শুয়ে পড়লাম। বিছানার নিচে দুটা হাঁস। বেড়ার ফাঁক গলে চাঁদমামার ডাকাডাকি। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার রাতজাগানিয়া চিরচির। বাইরে এখনও থেকে থেকে হাঁসগুলো ডাকাডাকি করছে। ইফতিও কিছুক্ষণ সজাগ ছিলো, একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। টেনশনে আমার তো আর ঘুম হয় না।
কান খাড়া করে শুনি কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠেছে। নিশুতি রাতে পাখির আওয়াজ কতদিন হলো শুনিনি। এমনকি বাড়িতে রাত জেগে সার্ভাইভাল প্র্যাক্টিস করার সময়ও না। একটু যেন তন্দ্রা এসে গেল। আবার টুটে গেলো। হাঁস ডাকছে বাইরে। ঘরেরগুলো একবারও ডাকাডাকি করেনি। কেউ একজন এখনও বাইরে ঘুরাঘুরি করছে। দিবারাহ-কে নিয়েই আমাদের যত টেনশন!
উত্তেজনার মধ্যেই আবারও কখন জানি তন্দ্রা এসে গেলো। যখন তন্দ্রা ভাঙলো তাকিয়ে দেখি দরজা হা করে খুলে আছে। সাঁই করে উঠে পড়লাম, তাকিয়ে দেখি প্রভা নেই। বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো। ডাক দিলাম, প্রভা…।
বাইরে থেকে উত্তর এলো, নয়ন ভাই আছি; টয়লেট…। আহ্! স্বস্তি পেলাম। প্রেশার নামলো মাথা থেকে।
আবারো তন্দ্রা, আবারো সজাগ। পা বাঁকা করে শু’তে শু’তে হাঁটুতে ব্যাথা হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তরুণের গায়ের উপর দিয়ে পা লম্বা করলাম। কোনো উপায় নেই। এদিকে লেপটা সরে গেলেই ঠান্ডায় হীম হয়ে যাচ্ছি। ওদিকে শুরু হয়েছে সবার নাক ডাকার কীর্তন – অপূর্ব ঐকতান: এর শেষ হয় তো ও’ শুরু করে, ওর শেষ হয় তো সে শুরু করে। নাক ডাকা নিয়ে রীতিমতো একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা যাবে।
এখনও গভীর রাত। ভীত নই, রাতকে ভয় পাই না — বরং উদ্বিগ্ন। এতোটা পরিশ্রমের পর একটা নির্ভেজাল ঘুম দরকার ছিল, এরকম আদোঘুম না। পাশের ঘরে মানুষের আনাগোনা। তারা কথাবার্তা বলছে। কী বলছে বোঝার উপায় নেই। আমাদেরকে ডাকাতি করে তো আর সোনাদানা পাবে না, সমস্যা একটাই: দিবারাহ।
একটা ভোর অতি আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠলো। উদ্বিগ্ন: ভোর কি হবে? দেখতে পাবো কি ভোরের আলো? নাকি…
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম
_____________________________
সংশোধনী (মার্চ ১০, ২০১৩): প্রকাশের পর প্রভা অনুযোগ করলো, বিজিবিদের মধ্যে কোনো অফিসার পদমর্যাদা নেই। যেকারণে বিডিআর বিদ্র্যোহ হয়েছিল। তাই লেখায় যত জায়গায় ‘অফিসার’ শব্দটি ছিল, সবগুলোকে ‘জোয়ান’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ‘বড় অফিসার’-কে ‘বড় স্যার’ আখ্যা দেয়া হয়েছে।