বই পর্যালোচনা: সুন্দরবনে বাঘের সন্ধানে

তখনও আমার বাসায় ইন্টারনেট ছিলো না; বন্ধু নাকিবের থেকে কয়েকটা ডকুমেন্টারি নিয়ে এসেছিলাম; তারই একটা ছিলো “Man-Eating Tigers of The Sundarbans” – দেরি না করে দেখতে বসে গিয়েছিলাম। আর একটু পরে যখন দেখলাম ভিডিওটাতে বাংলাদেশের পাশাপাশি একজন বাংলাদেশীই মূল উপজীব্য – তখন আগ্রহটা আরো বেড়ে গিয়েছিলো। বলছি মনিরুল খানের কথা। তিনি ২০০৪-এ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঘ-এর উপর পিএইচডি ডিগ্রী নেন। অনেক দেরিতে হলেও তিনি বাঘ নিয়ে বাংলায় একটি বই লিখলেন। যদিও তিনি এর আগে ইংরেজিতে লিখেছেন, কিন্তু সেগুলো কখনও পড়া হয়ে উঠেনি।

বইয়ের নাম: “সুন্দরবনে বাঘের সন্ধানে”
প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন

যাঁর বই পড়ছি, তাঁকে যেহেতু আগে থেকে চিনতাম, তাই বইটার আবেদন অন্যরকম ছিলো। তবে মনিরুল খানকে দেখলে একটাই কথা আমার সব সময় মনে হয়, এই ব্যক্তি হাসতে জানেন না। আর যিনি হাসতে জানেন না, তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ আমার অর্ধেকে নেমে আসে। কিন্তু এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার অর্ধেক আগ্রহ নিয়েও বইটা পড়ে যাই…

যেহেতু বাঘ দেখাই এই বইয়ের মূল উপজীব্য, তাই শুয়ে-বসে-দৌঁড়ে-সাঁতরে-সাইক্লোনে পর্যুদস্ত হয়ে বিভিন্নভাবে লেখক আর সঙ্গীরা বাঘ দেখেছেন। বাঘ দেখার মূল কারণ ছিলো, এটা তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো – বাঘ নিয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী নিবেন, তাই বাঘকে পর্যবেক্ষণ করেই তো গবেষণা অভিসন্দর্ভ লিখতে হবে। লেখক সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বিভিন্ন ছুতায় তিনি সুন্দরবনের বাঘকে দেখেছেন, দেখতে চেয়েছেন।

বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন আরেকজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী। প্রাঞ্জল ভূমিকাংশ পেরিয়ে “বাঘের হাতছানি” নামক লেখা দিয়ে লেখক তাঁর লেখার অবতারণা করেন। সেই পঞ্চাশের দশকে মধুপুর গড়ে তাঁর বাবার বাঘ দেখা দিয়ে শুরু। তারপর ১৯৯৫-এর অক্টোবর মাসে তাঁর পা পড়ে সুন্দরবনে, আর এর পর একের পর এক শুধু বাঘেরই গল্প। লেখক বলছিলেন, “দীর্ঘদিন সুন্দরবনে ঘুরাঘুরি করেও আপনি বাঘ না-ও দেখতে পারেন। কিন্তু বাঘ আপনাকে ঠিকই দেখবে।”

লেখক বাঘ দেখার ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি জেলে-বাওয়ালি-মৌয়ালদের বাঘের আক্রমণ থেকে ফিরে আসার গল্পও শুনিয়েছেন। প্রতিটা অধ্যায়েই আছে কিছু সাদাকালো ছবি – যেহেতু নিজে তিনি একজন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রীও, তাই জুৎসই ছবিগুলোও বাড়িয়ে দিয়েছে বইয়ের মর্যাদা। অনেক বাঘের গল্প-ছবির মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ঐ ছোট্ট ব্যাঘ্রশাবকটাকে – কী সুন্দর তুলতুলে চেহারা – অথচ কী ভয়ংকর এক শিকারী হতে চলেছে সে…।

বনে যেহেতু আছেন একজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, তিনি যে শুধু বাঘই দেখেছেন, তা কিন্তু না। তিনি বাঘের পাশাপাশি অন্য প্রাণীদেরকেও যে দেখছিলেন, সেটা লেখার পরতে পরতে বোঝা যায়। তবে বাঘের গল্পে সীমাবদ্ধ থাকতে গিয়ে সেসব বর্ণণা তিনি দীর্ঘায়িত করেননি। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বাঘেদের বিভিন্ন স্বভাব – একটা নিতান্ত ছোট্ট ফিঙে (ব্ল্যাক ড্রঙ্গো) কিভাবে সুন্দরবনের রাজা বাঘকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো – সেই দৃশ্যই কলমবন্দী করেছেন লেখক গবেষক মনিরুল খান।

লেখক লিখেছেন,

আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম পরে যখন কেউ বইটি পড়বে, আমার অভিজ্ঞতাগুলো জানবে, তত দিনে বাঘ আর সুন্দরবনের কী অবস্থা দাঁড়াবে জানি না। …এই বই সাক্ষ্য দেবে, আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম।

আমার মতে, বইটিতে অনেক অনেক বাঘ দেখার বর্ণনা থাকলেও একজন গবেষক এভাবে বাঘকে পর্যবেক্ষণ করলে বাঘের কী উপকার হয়, তা আমি বুঝলেও সাধারণ পাঠকের কাছে তা পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছেন লেখক – ভবিষ্যত সংস্করণে লেখার বিভিন্ন পরতে এই পর্যবেক্ষণ কিভাবে বাঘের আবাস, বিচরণ, নিরাপত্তা, মানুষের সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত করবে, লেখক তারও উল্লেখ করবেন বলে আমার অনুরোধ – তাহলে সাধারণ পাঠক বাঘ দেখার সাথে বাঘ গবেষণার সম্পর্কের সুতাটা টানতে পারবেন।

যারা সুন্দরবন ভালোবাসেন, সুন্দরবনে আগ্রহ রাখেন, ভালোবাসেন বাংলার গর্ব, প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে, বইটা আমি বলবো তাদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। প্রথমা প্রকাশন থেকে যেহেতু প্রকাশিত, তাই বানান, বিন্যাস আর বইয়ের পাতা থেকে শুরু করে বাইন্ডিং পর্যন্ত যত্নের ছাপ দেখা যায়। বইটির দাম ৳২২০।

অহাস্য বদনের মনিরুল খান আমাকে হাসি দিয়ে জয় না করতে পারলেও জয় করেছেন তাঁর কাজ দিয়ে। সুন্দরবন গবেষণা যে যেনতেন কাজ নয়, তা শুরুতেই খসরু চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই অসাধ্য সাধনকারী উল্লেখযোগ্য একজন ব্যক্তির বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় কোনো নিবন্ধ নেই দেখে আমি যার-পর-নাই হতাশ হয়েছি। তাই কালবিলম্ব না করে লেখকের জন্য একটি বাংলা উইকিপিডিয়া ভুক্তি তৈরি করতে দ্বিধা করিনি। বইটি লিখে তিনি যেমন আমাকে আলোড়িত করেছেন, তেমনি তাঁর প্রতি ভালোবাসাস্বরূপ আমার তরফ থেকে থাকলো এই উইকিপিডিয়া নিবন্ধটি: https://bn.wikipedia.org/wiki/মনিরুল_খান ❤ (উন্মুক্ত লাইসেন্সে একটা ছবি পেলে সোনায় সোহাগা হতো)

– মঈনুল ইসলাম


বই: সুন্দরবনে বাঘের সন্ধানে
মনিরুল খান
প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: মার্চ ২০২১
মূল্য: ৳২২০.০০
আইএসবিএন: 978-984-95400-7-6

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*