বই পর্যালোচনা: মসলার যুদ্ধ

ছোটবেলা মসলার যুদ্ধ নিয়ে আমাদের পাঠ্যবইতে কিছু পড়েছিলাম কিনা মনে নেই। কিন্তু রাঁধুনী একবার “মসলার যুদ্ধ” তাদের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছিলো, আর সেখানে সমুদ্রে কয়েকটা অ্যান্টিক জাহাজের একটা দৃশ্য ছিলো। দৃশ্যটা আমার মনে খুব গেঁথেছিলো। কিন্তু তবু ইতিহাসটা অতোটা গভীরে ঢুকে ঘেঁটে দেখার ইচ্ছা আর হয়ে উঠেনি। সম্প্রতি কোনো একটা কারণে বাংলাদেশের উপকূল নিয়ে আমি একটু গভীরে যাবার চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় তারিফুর রহমান নামের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে বইটি কিনেছিলাম। বইটা কেনা কতটা দারুণ ছিলো বলার জন্য এতটুকু বললেই যথেষ্ট হবে: এক বসায় পড়ে শেষ করেছি

লেখক সত্যেন সেনকে আমি চিনি না। কখনও তাঁর লেখা পড়িনি। কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে আমি তাঁর লেখার প্রেমে পড়ে গেছি। ইতিহাস বই যে এতো দারুণ করে লেখা যায়, আমি এই লেখা না পড়লে কিছুটা হলেও হয়তো অপরিচিতই থেকে যেতাম। আমাদের পাঠ্যবইতে ইতিহাসকে সবচেয়ে বীতশ্রদ্ধ করে ফেলা হয় সালের পরে সাল উল্লেখ করতে করতে। পরীক্ষাগুলোতেও নাম্বার পেতে হলে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সাল মনে রাখতে হয়। এই সাল মনে রাখতে রাখতে ইতিহাসের মতো গল্পের বিষয়, বাস্তব গল্পের রোমাঞ্চকর বিষয় আমাদের কাছে কখনোই রসকষপূর্ণ মনে হয় না। কিন্তু এখানেই সত্যেন সেনের কৃতিত্ব: তিনি লেখায় সালের উল্লেখ কিছু করেছেন বৈকি, কিন্তু পুরো বইটাই তিনি শ্রেফ গল্পাকারে বাস্তব ঘটনাগুলোই বিধৃত করেছেন। একেবারে নিরেট গল্প – বাস্তব ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ।

বইটিতে তিনি পর্তুগীজদের, ডাচদের (ওলন্দাজদের), ইংরেজদের, আরবদের, ভারতীয়দের, চীনাদের – সবার কথাই নিয়ে এসেছেন। কার কোন গুণ তাদের কিভাবে এগিয়ে দিচ্ছিলো – সেটাও উল্লেখ করেছেন, আবার কার কোন দোষের কারণে তারা ব্যর্থ হচ্ছিলো – সেটাও উল্লেখ করেছেন। এবং মসলার যুদ্ধের পেছনের গল্পটা বুঝতে হলে যে আপনাকে ক্রুসেডের গল্পটাও জানতে হবে – এটাতেও লেখকের অসাধারণ মুন্সিয়ানারই পরিচয় পাওয়া গেছে।

বইটা কেনার সময় রকমারি.কম-এ যখন সার্চ করি, তখন দুটো বই ইন-স্টক দেখাচ্ছিলো, তখন তুলনামূলক অপরিচিত প্রকাশনীর বদলে ঐতিহ্যবাহী মুক্তধারা প্রকাশনীকে এগিয়ে রেখেছিলাম। ৳১০[টাকা] বেশি দিয়ে হলেও এঁদের বই কিনেছিলাম। কিন্তু কেনার পরে যার-পর-নাই বিরক্ত হয়েছি। মুক্তধারার বই মানে একসময় শুধু নিউজপ্রিন্টের বই পেতাম। এই বইটা দেখলাম অফসেটে প্রিন্ট করা – ঐটুকুই সার হয়েছে। বইটাতে আমার কাছে কোনো যত্নের চেষ্টা করা হয়নি বলেই মনে হয়েছে। বইয়ে প্রচুর বানান ভুল পেয়েছি। ঐতিহাসিক বইয়ে বানান ভুল একটু গুরুতর অপরাধ মনে হয় আমার কাছে, কারণ অনেক নাম শুধু বানান ভুলের কারণে তথ্যের অনুসন্ধানযোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে। অথচ এটা ছিলো ১৯৮০’র প্রথম প্রকাশের পর বইটির পঞ্চম প্রকাশ। পাঁচ বারেও বানান ভুল সংশোধনের কি কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি?

চকচকে একটা প্রচ্ছদ করার চেষ্টা করা হয়েছে – যেটা এই বইয়ের অ্যান্টিক মূল্যকে শ্রেফ জলাঞ্জলি দেয়ার নামান্তর হয়েছে – কোথায় পর্তুগীজ ক্যারাভেল, ক্যারাক, গ্যালিয়ন – আর প্রচ্ছদে দেখা যায় একটা ডিজিটাল নৌকা থেকে কামান দাগা হচ্ছে – শ্রেফ বিরক্ত হয়েছি এই প্রচ্ছদে।

এরকম একটা ঐতিহাসিক বই, মূল বইতে না থাকলেও পরবর্তী মুদ্রণ কিংবা সংস্করণে বাড়তি কিছু জিনিস যোগের দাবি রাখে। যেমন: ঐসময়কার [নিদেনপক্ষে একটা] মানচিত্র, কিংবা উল্লেখিত দেশগুলোর অবস্থান এবং সমুদ্রপথে গমনাগমনের পথ উল্লেখ করে একটা আধুনিক মানচিত্রও দেয়া যেতো। কিছুই নেই – লেখকের মূল গল্পের সাথে কিছুই যোগ করার প্রয়াস তো ছিলোই না, উল্টো নিজের সুনামের ডঙ্কা বাজিয়ে ৳১০[টাকা] বেশি দাম ধরে বিশ্রী প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরকম একটা অসাধারণ বইতে বিন্দুমাত্র উপযোগ যোগ না করে পঞ্চম মুদ্রণ অবধি পথচলায় মুক্তধারার প্রতি আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি।

আমি বই পড়ি খুব ধীরে। কিন্তু ৭০ পৃষ্ঠার অসাধারণ এই বইটি আমি এক বসায় শেষ করতে পেরেছি – এক বসায় শেষ করা এটা আমার দ্বিতীয় বই। বইটা আমার এতোটাই ভালো লেগেছে, কিংবা বইটা ভালো লাগার মতোই একটা বই বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। শেষ করবো বইটার একটা অসাধারণ উক্তি দিয়ে। লেখক লিখেছেন:

…যুগ যুগ ধরে এই রীতিই প্রচলিত হয়ে আসছে। পররাজ্য লুণ্ঠন বা জয় করবার জন্যই হোক, অথবা মানুষকে অত্যাচার বা শোষণ করবার জন্যই হোক, কি খ্রীস্টান, কি হিন্দু, কি মুসলমান সকলের [ঈশ্বরকেই] ভক্তদের সঙ্গে এই কাজে শরীক হতে হয়। অতীতেও তাঁদের (ঈশ্বরদের) এই দায়িত্ব ছিল, বর্তমানেও তা শেষ হয়ে যায় নি।

সত্যেন সেন (মসলার যুদ্ধ)

বই: মসলার যুদ্ধ
লেখক: সত্যেন সেন
মূল্য: ৳১২৫.০০
আইএসবিএন: 978-984-8858-86-8

মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*