সমুদ্রের বয়স কত: কিভাবে মাপা হয়?

আচ্ছা, সমুদ্রের বয়স কত? পৃথিবীতে এতো এতো মহাপন্ডিত থাকলেও বিজ্ঞানীরাই আমাদের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। তাও সব বিজ্ঞানী না, ভূবিজ্ঞানী কিংবা পানি বিজ্ঞানী। কিভাবে তাঁরা সেটা করবেন?

পদ্ধতি ১: পৃথিবীর সমস্ত নদীতে কতখানি লবণ আছে তা মাপা হয়েছে। প্রতি বছর পৃথিবীর সমস্ত নদী থেকে কতখানি লবণ সমুদ্রে এসে পড়ছে, তাও মাপা হয়েছে। এই দ্বিতীয় সংখ্যা দিয়ে প্রথম সংখ্যাকে ভাগ করলে ‘সমুদ্রের বয়স’ পাওয়া যায়।

সমুদ্রের বয়স = (পৃথিবীর সব নদীর লবণ) ÷ (এক বছরে সমুদ্রে পড়া লবণ)

পদ্ধতি ২: পৃথিবীর সমস্ত নদী কতখানি মাটি বয়ে নিয়ে যায় তাও মাপা হয়েছে। এই মাটি ধীরে ধীরে সমুদ্রতলে তলানি হয়ে জমে শিলার রূপ নিয়েছে। একে বলা হয় ‘পাললিক শিলা’। এই পাললিক শিলার ‘গভীরত্ব’ মেপে সেই সংখ্যাকে প্রতি বছর নদীবাহিত সমুদ্রগর্ভের মাটির পরিমাণের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে সমুদ্রের বয়সের একটা ধারণা পাওয়া যায়।

সমুদ্রের বয়স = (পাললিক শিলার গভীরত্ব) ÷ (এক বছরে সমুদ্রে পড়া মাটি)

এতটুকু আমি জেনেছি বাংলাদেশের একটা পাঠ্যবই থেকে। কিন্তু মনে একটা প্রশ্ন আমার মনে হয় আপনাদেরও খচখচ করছে যে, ঐ বিজ্ঞানী ব্যাটারা পৃথিবীর এত এত নদীর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পানির লবণ কিভাবে মাপলেন? এটা কি বাথরুমের বালতির পানি পেয়েছে নাকি? দুঃখের কথা হলো: উত্তরটা আমারও জানা নেই। যেদিন জানবো, সেদিন তাও ইনশাল্লাহ জানাবো। তবে এখন একটা ধারণা করতে পারি আমরা:

যেমন আদমশুমারির লোকেরা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় জানার জন্য সারা বাংলাদেশের স-ব লোককে গিয়ে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করেন না। তারাও অনেকের কাছে যেতে পারে না। তারপরও ওটাকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হিসেবে ধরা হয় (যদিও অনেকের আয় তাতে বাদ পড়েছে)। তেমনি নদীর লবণ হিসাব করার ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণ লবণ বাদ পড়লে ক্ষতি নেই। ওটাকে পরিসংখ্যানের ভাষায় স্ট্যান্ডার্ড এরর (পরিমিত ভ্রান্তি?) হিসেবে মেনে নেয়া হয়।

এবারে ধরা যাক, বিজ্ঞানীরা পদ্মা নদীর লবণাক্ততা পরিমাপ করবেন। তাঁরা পদ্মা নদীর মুখে গিয়ে কিছু পরিমাণ (মানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ, ধরা যাক এক লিটার) পানি নিবেন, আর তার লবণাক্ততা পরিমাপ করবেন। এবারে ধরা যাক আরো একশ মাইল দূরে এসে তাঁরা আরো কিছু পানি নিলেন এবং লবণাক্ততা পরিমাপ করলেন। এভাবে কয়েক’শ মাইল পরপর পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করা শেষে তাঁরা এতটুকু ড্যাটা’র গড় (average) করবেন, যাকে পরিসংখ্যানের ভাষায় মীন (mean) বলে।

আপাতত এই গড় বোঝাচ্ছে প্রতি একশ মাইল পরপর নদীর পানিতে লবণাক্ততা এত পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এবারে তাঁরা আরো কয়েক হাজার মাইল দূরে গিয়ে এভাবেই আরো কয়েক’শ মাইলের লবণাক্ততার পরপর হিসাব নিবেন। ওখানকার হিসাবেরও মীন করা হবে। এই যে হাজার মাইল দূরে গেলেন তাঁরা, কেন গেলেন? কেন তাঁরা কয়েক লাখ মাইল দূরে গেলেন না? আসলে এটাও পরিসংখ্যানের একটা বিষয়, এটাকে বলা হয় র‌্যান্ডম স্যাম্পলিং (random sampling), বাংলায় দৈব চয়ন। আপনার ইচ্ছা হলে আপনি কয়েক লাখ মাইল দূরের স্যাম্পল সংগ্রহ করতে পারেন। তবে যদি তা করেন, তবে প্রত্যেকবারই তা-ই করতে হবে। তাহলে এটা তথ্যের সত্যনিষ্ঠতা বোঝাবে।

এভাবে সমুদ্রে যেখানে পদ্মা নদী গিয়ে মিশছে, সেখানকার কাছাকাছি কয়েকশ মাইলেরও লবণাক্ততার পরপর হিসাব নিয়ে ওটারও মীন বের করা হবে। এই যাবতীয় মীনগুলো নিয়ে বসা হবে। তারপর সেই মীনগুলোর আরেকটা মীন বের করা হবে। এই শেষে যে মীনটা বেরোল, এই মীনটাকে স্ট্যান্ডার্ড (standard, বাংলায় পরিমিত মান) ধরা হবে। এই স্ট্যান্ডার্ড মীন বোঝাচ্ছে: পদ্মা নদীর পানি প্রতি একশ মাইলে এতটুকু লবণ বাড়িয়ে নিয়েই এগিয়ে চলেছে। ব্যস, মূল কাজ শেষ।

এবার পুরো পদ্মা নদীর মুখ থেকে সমুদ্রে মেশা পর্যন্ত দূরত্বটুকু পরিমাপ করা হবে, মানে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য মাপা হবে। পুরো দৈর্ঘ্যকে ঐ একশ মাইলের লবণাক্ততার স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে হিসেব করলে বেরিয়ে আসবে পদ্মা নদী কতটুকু লবণ বহন করে নিয়ে যায় সমুদ্রে।

আমার মনে হয় এটা এক ধরণের পদ্ধতি হতে পারে, আমি জানি না। তবে বিজ্ঞান অনেক উন্নত। উন্নত বিজ্ঞানের কাছে বিশেষ অতিবেগুনি (ultra-violet) যন্ত্রপাতি আছে, তা দিয়ে নদীগুলোর ক্যামিক্যাল ডিটেলস বা রাসায়নিক বিস্তারের ছবি সংগ্রহ করা যাবে। ছবিতে একেক রং একেক রাসায়নিক পদার্থের ধারণা দেয়। এই পদ্ধতিতে হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশের গ্যাসের ছবি সংগ্রহ করে অবশ্য। তারপর লবণের রাসায়নিক উপাদান (সোডিয়াম এবং ক্লোরিন) কোথায় কতটুকু আছে, তার হিসাব করে পুরো পদ্মা নদীর লবণাক্ততার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব বের করতে পারেন।

বিজ্ঞান অনেক উন্নত, আমাদেরকে তার সাথে তাল মেলাতে বেশি বেশি জানতে হবে। আমরা যদি প্রেম নিয়ে আলাপে রত থাকি, আমরা যদি প্রফেশন নিয়ে আলাপে রত থাকি, আমরা যদি সার্টিফিকেশন নিয়ে আলাপে রত থাকি, তাহলে জানবো কী করে এসব? প্রেমের অতিআলোচন পৃথিবীতে মানুষকে মাতিয়ে রেখেছে, উপকার দেয়নি; প্রফেশনের অতিআলোচন লোভি করেছে, উপকার দেয়নি; সার্টিফিকেশন আর ডিগ্রী মানুষের পাশাপাশি অনেক গরুও বানায়, মানুষকে তোলেনি। কিন্তু বিজ্ঞান যেমন অতীত জানিয়েছে, ভবিষ্যতও জানাচ্ছে। তুমি যখনই বিজ্ঞান নিয়ে অতিআলোচনা করবে, তখনই আরেকজন আইনস্টাইনের জন্ম হবে, যে বুকে থাবা দিয়ে প্রচলিত ‘আলো তরঙ্গ’ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করবে ‘আলো কণাও’। আমরা এমন একটা শক্তিশালী জাতি চাই। প্রেমে টগবগ করা ভঙ্গুর জাতিরা উপরে ওঠেনি।

– মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*