অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৪)

রাসেলের বাম পায়ের পাতায় ব্যথা করছে। সম্ভবত তার পা বাঁকা হয়ে কোথাও পড়েছে, তাই ব্যাথা করছে। কিন্তু সে হাঁটতে পারছে, তাই আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার সম্ভাবনা নেই। আমরা আমাদের প্ল্যানেই থাকলাম। গাইড দুজনকে অনুসরণ করে আমরা একটা ত্রিপুরা পাড়ায় পৌঁছলাম। পাড়াটার নাম বিকাশ বলেছিল, কিন্তু লিখে রাখিনি তখন। বগামুখ থেকে নেমে এসে আমরা এই পাড়ার উপর দিয়ে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, “বগামুখ” নামটাই সঠিক, “বগা মুখ” সঠিক নয়। স্থানীয়রা ওটাকে একত্রে উচ্চারণ করেন (তাছাড়া সমাসবদ্ধ পদ একত্রে লিখার নিয়ম)।

যাহোক এই ত্রিপুরা পাড়ার ভিতর দিয়ে পার হবার সময় একজায়গায় দেখলাম বেশকিছু এপিটাফ বা কবর-ফলক। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, প্রত্যেকটাতে ক্রুশের ছবি (পরে অবশ্য গা-সওয়া হয়ে গেছে); আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রত্যেকটা কবর-ফলক খুব কাছাকাছি, একটু বেশি ঘনঘন লাগানো। আরো একটা বিষয় স্পষ্ট হলো, ত্রিপুরারা এখন আর নিজেদের লিপি ‘ককবোরক লিপি’ ব্যবহার করে না, খ্রিস্টানদের উপহার দেয়া ল্যাটিন হরফ দিয়ে নিজেদের ভাষা লিখে। …কবর-ফলকগুলো যেখানটায় শেষ, ঠিক তার গা ঘেষে একটা বেড়া-পথ। ভিতরে একটা টিনের ছাউনির বাঁশের ঘর। দরজার উপরে মাইক লাগানো দেখে প্রথমে মসজিদ ঠাওরালেও কবর-ফলকগুলো স্পষ্ট করে দিলো ওটা একটা গির্জা —এই ত্রিপুরা পাড়াও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। তবে গির্জাটা স্কুল ঘরের মতো ল্যাটিন আই আকৃতির, প্রচলিত ক্রুশাকৃতির ভূমি-নকশায় নয়।

গির্জার পাশ দিয়ে এগিয়ে সামনে যেতেই আপেল নাকি বিকাশ বললো, পাশেই উপরের টিলাতে রয়েছে একটা বাদুড় গুহা। খবরটা আবুবকর ভাইকে জানালাম। সেই ঝিরিতে যখন নেমেছি, তখন থেকেই আবুবকর ভাই তাঁর জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইসে কোঅর্ডিনেট নিচ্ছিলেন। কোঅর্ডিনেট নেয়ার জন্য কিছুই করতে হয় না, ডিভাইসটা চালু থাকলেই হয়। আবুবকর ভাইয়ের কাজ হলো বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো একটা নাম অথবা মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা। এব্যাপারে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সাথে ঘুরাঘুরির সুবাদে; ডিভাইসটা আসলে দলেরই। আবুবকর ভাইয়ের রিডিংমতে, বাঁদুড় গুহার কোঅর্ডিনেট 22° 1’21.36″N, 92°27’37.55″E।

আমি সামনে এগিয়ে চললাম, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ওরা বেশ একটু পিছনে পড়ে গেছে। আমি ভাবলাম কামরুল বোধহয় বাদুড় গুহা দেখতে চলে গেছে। পরে জানলাম রাসেলের পায়ে ভালো ব্যথা পেয়েছে, ওকে সহায়তা করার দরকারে কামরুল পিছিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা এগিয়ে এলো, রাসেলকে পা ফেলতে সহায়তা করার জন্য গাছের একটা লম্বা ডাল দিয়ে লাঠি বানিয়ে দেয়া হয়েছে। তা নিয়ে সে এগিয়ে আসছে, একটু স্বস্থি হলো।

বড় বড় পাথরের মাঝে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করতে থাকলাম। বড় বড় শিমুল গাছ তার লাল ফুলের শোভা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিল। শান্ত নিথর পানির ভিতরে সূক্ষ্ম জলপ্রবাহমাত্র —কোনোরকমে জলের ধারা বইয়ে রেখেছে পাথরের দঙ্গলে। কোথাও পানি এতোটাই নিথর যে, ব্যাঙাচির শান্তির আবাস গড়ে উঠেছে বেশ। স্বচ্ছ পানিতে কালো চকচকে ব্যাঙাচিগুলোকে দেখে বেশ সুস্বাদু লাগছিল (সত্যি বলছি)। 🙂

ঝিরিপথ যেখানে দুপাশে মাঝারি উঁচু পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা, সেখানে দূ—রের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো আবারো হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমাদের। আমরা যেন সেই ডাকে সাড়া দিয়েই এগিয়ে চলেছি। দলটা একটু শ্লথগতিতে চলছে রাসেলকে সাথে নেবার জন্য। রাসেল দেখি পা ভালো করেই মচকেছে!

পাথরের বিছানা, উজানের দিকে খাঁজ
পাথরের বিছানা, উজানের দিকে খাঁজ (ছবি: নাকিব)

পথ কিছুটা একঘেয়ে, পাথর, পানি, পানির মাঝখানে জেগে থাকা পাথর, গাছ, নুড়ি পাথর —এরকমই। আমাদের পথচলা চলছে, কামরুল আর রাসেল একটু পিছিয়েই আছে। নাকিব তার ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছে। আর তখনই সামনে পড়লো একটা পাথরের বিছানা। পাথরের বিছানাতো আর সমতল হয় না, এবড়ো-খেবড়ো। পানি শুকিয়ে গেছে। যদি বর্ষাকাল হতো, তাহলে এই মুহূর্তটা হতো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত, যখন পানির তীব্র স্রোত এসে পার হতে চাইতো এই পাথরের বিছানার উপর দিয়ে, তখনই সৃষ্টি হতো অপূর্ব এক দৃশ্য, কারণ পাথরগুলো ভাঁজ হয়ে আছে উজানের দিকে। ব্যাপারটা আমার কাছে আশ্চর্যই লাগলো, কারণ পানির তীব্র ঘর্ষণে পাথরে যদি খাঁজ হয়ই, তাহলে সেটা হবে ভাটির দিকে, যাতে পানি আরামে যেতে পারে। কারণ পানির ধর্মই হলো বাঁধাকে সরিয়ে দেয়া, আর না পারলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। কিন্তু বর্ষাকালে নিরন্তর ঘর্ষণসত্ত্বেয় এখানকার খাঁজগুলো মানে উত্তল দিকটি কেন উজানের দিকে —তা আমার কাছে আশ্চর্যই হয়ে থাকলো। কামরুল সয়েল সায়েন্স বা মৃত্তিকা-বিজ্ঞানের ছাত্র; সে, দায়িত্বটা ভূতত্ত্বের ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হলো।

আবার আমাদের পথচলা। এবারে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, স্বর্গ এসে মর্তে জায়গা করে নিলো। অপূর্ব এক পাহাড়ি খাঁজে গিয়ে আমরা হাজির হলাম, যেখানে দুপাশে উঁচু পাহাড়ি ঢাল, মাঝখানে গভীর পানির খাঁজ, আর দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ধু ধু বাতাস এসে উড়িয়ে নিচ্ছে আমাদেরকে স্বর্গের কোনো এক দুয়ারে। কাচ-স্বচ্ছ সেই পানিতে আসলে দেখা যাচ্ছিল অনেক অনেক গভীরে থাকা পাথুরে সবুজ শ্যাওলাগুলো, তাই পানিকে সবুজ লাগছিল। সুশান্ত পানি দেখলে বোঝার উপায়ই নেই যে, ভিতরে ভিতরে একটা প্রবাহ আছে। দুপাশে পাথরের খাঁজগুলো রীতিমতো গভীর ভাঁজের।

পথটা এবার সেই পাথরের চাপা খাঁজ ধরে গেছে। আপেল এগিয়ে গিয়ে জানালো, সামনে পাথরটা হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে, আর সেখানে নামার জন্য পাহাড়িরা দুটো বাঁশ লাগিয়ে রেখেছে। আবুবকর ভাই শুনেই বললেন, না, বাঁশ বেয়ে নামা যাবে না; অন্য পথ দেখো। অন্য পথ তো আর নেই। একটাই আছে, সাঁতরে যেতে হবে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে টীম-লিডার কেন জানি সাঁতারের সিদ্ধান্ত নিলেন না। তাকালেন পাহাড়ের দিকে।

আপেল আর বিকাশ, হাতে দা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে উঠে পড়লো খাড়া পাহাড়ে। কিছুক্ষণ পরেই জানালো, উঠে আসেন। ব্যস, শুরু হলো পাথুরে পাহাড় বাওয়া। তখনও বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারিনি যে, আমরা কোথায় উঠতে যাচ্ছি। যখন উঠে পড়লাম, তখন বুঝতে পারলাম, আমরা একটা ৮০ ডিগ্রি খাড়া ঢালে দাঁড়িয়ে।

সবার সামনে আমাদের দুই গাইড, তার পরেই আবুবকর ভাই, তারপর রাসেল, নাকিব, আমি আর সবার পিছনে কামরুল। রাসেল তার লাঠির উপর ভর দিয়ে এতক্ষণ চলছিল, এখন সেই লাঠি ফেলে দিয়ে দুই হাত দিয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে নিজের পতন ঠেকানোই সমিচীন মনে করলো।

এই প্রথম আমার পাহাড়ে ট্রেকিং, নিচে গভীর খাদ, অবশ্য খাদে যাবার আগে পাথরে ঘষটে ঘষটে হাত-পা পঙ্গু হয়ে হাসপাতালের খোরাক হয়ে যাবে তার আগেই, তার-উপর এত্তো খাড়া ঢাল, সাথে আমাদের সাপোর্ট দেয়ার মতো ভারি কোনো রশি নেই যে রোপিং করে পাহাড় পাড়ি দিব। কিন্তু এই প্রথম আমি আমার ন্যাপস্যাকটার উপকারিতা পুরোপুরি টের পেলাম: এক্কেবারে আঁটোসাটো হয়ে পিঠের সাথে লেগে আছে, ওজন কমিয়ে আনায় ওটা বহন করতে মোটেই ‘বোঝা’ মনে হচ্ছে না, ছোট হওয়ায় কোথাও আটকে বাধা সৃষ্টি করছে না; আর পিঠে ঝুলে থাকায় দুই হাত এক্কেবারে আরাম্‌সে ব্যবহার করতে পারছি। এদিকে ৳১১০ [টাকার] জুতাও যে হিরোতে রূপ নিবে, বুঝতে পারিনি। এত্‌তো অপূর্ব গ্রিপ দিয়ে আমাদের বাঁকা হয়ে থাকা পা-গুলো আটকে রাখলো ঐ পাথরের মাঝে যে, বলাই বাহুল্য হবে।

কিছুটা ভয়ও কাজ করলো ভিতরে ভিতরে। মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসলো। কারণ আমার দুটো-রড-ঢোকানো-ভাঙা-হাত নিয়ে বান্দরবান আসতে দিতে তাঁর খুব একটা সম্মতি ছিল না। এখানে পড়ে মরলে সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ হবে তাঁর। কিন্তু, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আঁশ: আমরা পথচলা চালিয়ে গেলাম।

সামনে এগোতেই পাক্কা ৮০ ডিগ্রী খাড়া ঢাল, সারিবদ্ধ আমরা পাঁচ জন, পায়ের নিচে গুড়ি গুড়ি নুড়ি পাথরের ছড়াছড়ি, নিজের শরীরের ওজন আর ব্যাগের ওজন মিলে মাধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে টানছে; পা হড়কালে ১০০ ফুট নিচের পাথুরে খাঁদে চির সমাধি, তাও শুধু একজনের নয়, নিচে, খাড়া পাহাড়ের সাথে ঝুজতে থাকা আরো তিনজনেরও।

পা রাখতে খুব মাপতে হচ্ছে আমাদের। এমনকি আবুবকর ভাইও বেশ একটু ধীর হয়ে গেলেন। তাঁর সমস্যা হলো ভারি ব্যাগ। কিন্তু ঐ ব্যাগ নিয়েই তিনি নামতে চাইলেন। ধরার তেমন কিছুই নেই, বেশকিছু আলগা পাথর-মাটি খসালে কখনও বেরোয় একটু চোখা কোনো পাথর, তাতে কোনোরকমে হাতটা বাঁধিয়ে নিজের ভার স্থানান্তরের উপযোগী করে পা তুলতে হয়। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আবুবকর ভাই নামলেন। তার পিছনে রাসেল নামলো নুড়ি-পাথরের মেঝেতে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে। নাকিবকে তার খানিকটা মোটা শরীর নিয়ে একটু বেশিই কসরত করতে হলো। আমি আমার লিকলিকে শরীরখানা নিয়েও যে খুব সাবলীল ছিলাম, তা না। প্রথম ট্রেকিং হিসেবে বেশ খাটিয়ে ছাড়লো ঢালটা। পিছনে কামরুলকে দেখলাম নিজের শরীরের ওজন নিয়ে বেশ কষ্টই করছে। তবে কষ্ট হলেও সবাই-ই কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই নেমে এলাম ওপারে।

নেমে সবাই-ই বেশ খানিকটা ক্লান্ত। তবে আশার কথা হলো, আমরা পেরেছি। বিশেষ করে আমি, নাকিব আর রাসেল সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হলেও আমরা পেরেছি। তারও চেয়ে বিশেষায়িত, কারণ রাসেল তার মচকানো পা নিয়েও সে যে পার হয়েছে, এটা আশার কথা। এপারে পাথরের ফাঁক গলে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে সেই খাদের দিকে। আমরা বোতলে পানি ভরে খেয়ে নিলাম সবাই তৃপ্তি ভরে।

আমি আর আবুবকর ভাই ছুটে গেলাম সেই বাঁশের কাছে, যেদিক দিয়ে নামা যেত। গিয়ে দেখি ওই দুটো শুধু বাঁশ নয়, বরং ছিদ্র করা বাঁশ। ঠিক মইয়ের মতোই প্রত্যেকটা বাঁশে নির্দিষ্ট দূরত্বে ছোট ছোট ছিদ্র করা হয়েছে, শুধু মইতে দুটো বাঁশকে জোড়া লাগায় ছিদ্রগুলোতে জায়গা করে নেয়া আরো কিছু কাঠি, এখানে সেই জিনিসটা নেই। আমি তরতরিয়ে ঐসব গর্তগুলোতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঢুকিয়ে উঠতে লাগলাম এটা বোঝার জন্য যে, জিনিসটার ব্যবহার কেমন করে হয়। আবুবকর ভাই বেশ আশ্চর্য হলেন আমার কম্ম দেখে, কামরুলকে ডেকে বললেন ছবি তুলতে।

আমি ততক্ষণে নেমে আবার উঠলাম। এবারে নামার সময় আমি পায়ের দ্বিতীয় আঙ্গুল দিয়ে নামলাম, এবং আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, বুড়ো আঙ্গুলের চেয়ে এই আঙ্গুল দিয়ে আরো আরামে উঠা-নামা করা যায়। তবে এটা বুঝতে পারলাম, ঐ পাহাড়-চড়ার চেয়ে সহজেই আমি অন্তত এই বাঁশ বেয়ে নামতে পারতাম। 🙂 যাহোক পেয়ে গেলাম দুই পাহাড়ি কিশোরকে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কিভাবে উঠে। ওরা জানালো, ওরা বুড়ো আঙ্গুল দিয়েই উঠে।

যাহোক, আমরা আবার পথ চলার তাগিদ অনুভব করলাম। ওদিকে রাসেলের পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। আবুবকর ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে তাকে একটা নাপা (পেইন কিলার) খাইয়ে দিলাম। তারপর আবার পথচলা। রাসেল তার পা টেনে টেনে হাঁটছে।

আরোও আরোও সৌন্দর্য্য, আরো আরো অপূর্ব সব দৃশ্য… কত আর বলি? আমরা আমাদের পথচলা থামাই না। কোথাও পাহাড়ের গায়ে পাথরের স্তর দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, কোথাও পাথরের মেঝেতে কারুকাজ দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, কোথাও একটা পড়ে থাকা গাছের দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি এর পতনের কারণ। পথ চলছি।

আরো বেশ কিছুদূর যাবার পর আমরা পৌঁছে গেলাম এক অপূর্ব স্থানে, যেখানে খুবই ছোট্ট, মাত্র তিন কি সাড়ে তিন ফুট উঁচু একটা ঝরণা। ঝরণার পানির কলকল, পাথরের খাঁজ ধরে আসা বাতাসের তীব্র প্রবাহ আমাদের ক্লান্তিকে এক্কেবারে ধুয়ে দিয়ে যেতে লাগলো। পাথরের উপর বসে বিশ্রাম নিতে চাইলো সবাই, আসল কথা বিশ্রাম না, দৃশ্য উপভোগ। দলনেতাও সায় দিলেন। ব্যাগগুলো কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে একটু আরামে হাঁটাহাঁটি করার সুযোগ হলো। রাসেল শুয়ে নিজের পা-কে একটু বিশ্রাম দিতে চাইলো। কামরুল চলে গেলো ছবি তুলতে, নাকিব আর আমিও একই পথে।

যে পথে আমরা এসেছি, সেদিকে তাকিয়ে কী যে অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম, সে নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। মনে হলো আমি জাপানে বসে আছি। ক্যামেরায় সেটা আপনাদের খানিকটা দেখানো যেতে পারে, কিন্তু উপভোগের মজাটা কী, সেটাতো বলে বোঝানো যাবে না। উঠতে মন চাইছিল না জায়গাটা ছেড়ে। তবু পানি-পান, দৃশ্য-ভক্ষণ আর বিশ্রাম-গ্রহণ শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম। বিদায় জানালাম জাপানকে।

সামনে সব বড় বড় পাথর। এর মাঝে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি বিকাশকে দেখা যাচ্ছে ঐ যে দূরে একটা পাহাড়ের গভীর খাঁজে। ছবি তুললাম। আরো একটু সামনে গিয়ে রীতিমতো টাশকি খেলাম: এটা কী!!!

ইয়া— ব–ড়-একখান পাথর। বিশা—লাকৃতির। বলা যায় প্রায় দুই তলার সমান। ওটার পাশ দিয়ে যেতেও ভয় করে, যদি গড়ান দিয়ে গায়ের উপর এসে পড়ে, শ্রেফ ভর্তা হয়ে যাবো। এই জায়গাটা সিরিয়াস সব পাথরের আড্ডাখানা। দেখে মনে হতে পারে, সবগুলো একসাথে গল্প করে করে গোসল করবে বলে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ঝিরিতে!

কোনো রকমে এই সাবু-পাথরগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। রাসেলকে বেশ বেগ পেতে হলো এগুলোকে পার করতে, কিন্তু সেও এগিয়ে চললো ব্যাথাকে দমিয়ে রেখে। কিন্তু সামনে আমাদের নিয়তি যে কী নিয়ে অপেক্ষা করছে, ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি আমরা। সামনের এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে প্রথমে আমি কিছুটা বোবাই হয়ে যাই: সৌন্দর্য্যে না, ঝঞ্ঝাটের চিন্তায়! আবার কি পাহাড় বাইতে হবে?

মাঝখানে গভীর পানি, দুই পাশে পাক্কা ৯০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়। যাও এবার সামনে!!

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

_________________________________

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যাবতীয় ভৌগোলিক কো-অর্ডিনেট “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সদস্য আবুবকর-এর সহায়তায় প্রাপ্ত।

৭ thoughts on “অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৪)

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*